নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
“ভারতবর্ষ থেকে ডি.এল.বি. ঠাকুর কী লিখবে, গোপালগঞ্জ থেকে আমাদের শ্রদ্ধেয় হরপ্রসাদ বাগচি বাবু তিনি তার আপন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কী বলবেন, এটি কোনো কথা নয়।”
--- সাগরচাঁদ সাধু ঠাকুর
‘মুক্তির আহ্বান’ নামক একটি সংগঠন কর্তৃক গত ২১ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে খুলনার ফেলাতলা এলাকার ‘হোটেল অ্যাম্বাসেডর’-এ ‘বৃহত্তর হিন্দু সমাজ গঠনের পথে অন্তরায় ও সমাধানের উপায় উদ্ভাবন’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে মতুয়াদের শ্রীপাট লক্ষ্মীখালীর সাগর সাধু ঠাকুর উপরিউক্ত কথাটি বলেছেন। তার বক্তব্য সম্পর্কে কিছু কথা, যা বলা উচিত নয়, তবুও বলি।
১। সাগর সাধু ঠাকুরের ‘মতুয়া পরিচয়’ বংশগত, রক্তগত, জাতিগত। কারণ এই বক্তব্যে তিনি বলেছেন, “আমি মতুয়া, আমি বৈষ্ণব, আমি শৈব, আমি শাক্ত; এটি আমার পরিচয়। এটি আমার বংশগত, রক্তগত, জাতিগত, যে যা গত হোক না কেনো, আমার ঐতিহ্য, সমস্ত কিছুই ঠিক আছে।”
--- আচ্ছা, আপনারাই বলুন, মতুয়া, বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত–এগুলো কী বংশগত, রক্তগত, জাতিগত? অন্যগুলো সম্পর্কে যে যা-ই বলুক, মতুয়া পরিচয় কখনও বংশগত নয়, রক্তগত নয়, জাতিগত নয়। বংশগত-রক্তগত-জাতিগত বিষয়টি স্পষ্টত ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির ধারক-বাহক। আমার মতে ‘মতুয়া পরিচয়’ হলো আদর্শগত-ধর্মগত-সম্প্রদায়গত পরিচয়। আপনারা কী বলেন?
২। সাগর সাধু ঠাকুর বিশ্বাস করেন মতুয়ারা হিন্দু। কারণ এই বক্তব্যে যারা মতুয়াধর্মকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ধর্ম বলে মানেন, প্রচার করেন, তাদের কটাক্ষ করে বলেছেন, “একদলে আবার ইদানীং সময় এটাও বলছে যে, মতুয়ারা হিন্দু না, হিন্দু কোনো ধর্ম না; এটি আপনারা শুনেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরজি, তিনিও বছর তিনেক আগে একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, হিন্দু ধর্ম নয়- একটি সংস্কৃতি।” তিনি আরও কটাক্ষ করে বলেছেন, “আমি মতুয়া, আপনারা কি শুনেছেন কোথাও ‘মতুয়ারা হিন্দু না’? এটা নিয়ে বই লেখা হয়েছে, বিবাহ-শ্রাদ্ধ নিয়ে পাণ্ডিত্য হচ্ছে। শুনেছেন? সবাই জানেন তো?”
--- সাগর সাধু ঠাকুর বিশ্বাস করেন মতুয়ারা হিন্দু। তার বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। কিন্তু সমস্ত মতুয়ার বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তাকে অধিকার তাকে কে দিল? মতুয়াদের মধ্যে বর্তমানে দুই ধরনের বিশ্বাস প্রচলিত।
ক) একটা অংশ মনে করে তারা হিন্দু, তারা হিন্দুর অংশ। এই দলের মধ্যে সাগর সাধু পড়ে।
খ) আরেকটা অংশ মনে করে মতুয়াধর্ম স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ধর্ম; হিন্দুধর্মের অংশ নয়। এদেরকে বলতে পারেন সংস্কারপন্থী মতুয়া। এই দলের মতুয়ারাই তাদের ধর্মকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রচলিত হিন্দু সংস্কৃতির বিভিন্ন বুজরুকির বিপরীতে মতুয়া সংস্কৃতি চালু করতে সচেষ্ট। এই অংশটিই মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে, এরাই মতুয়াদের জন্য আলাদা বিবাহ পদ্ধতি, পূজা পদ্ধতি, শ্রদ্ধা (শ্রাদ্ধের বিপরীতে) পদ্ধতি ইত্যাদি সংস্কৃত চালু করেছে, করছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সংস্কারপন্থীরাই পরিবর্তন ঘটায়, এবং সে পরিবর্তন অধিকাংশক্ষেত্রেই শুভ পরিবর্তন হয়। কারণ এরা প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে যুক্তি-বুদ্ধি-চেতনার প্রয়োগ করেই লড়াইটা চালায়। কিন্তু ফল সবাই ভোগ করে। একটা সময় হিন্দু সমাজের সংস্কারপন্থীরাই ব্রাহ্ম্যধর্ম/ব্রাহ্ম্যসমাজ গঠন করেছিল। সমাজ সংস্কারে তাদের অবদানের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বাংলার সংস্কার আন্দোলনে ডিরোজিও বাহিনীর কথা কারো নিকট অবিদিত থাকার কথা নয়। অন্ধ ধর্মীয় প্রথা-পরম্পরার বিরুদ্ধে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয়, অবজ্ঞা করলে ক্ষতি নিজেদেরই হয়। মতুয়াদের মধ্যে সংস্কারপন্থীদের এতোটা কটাক্ষ সাগর সাধু কীসের স্বার্থে করতে পারে?
৩। সাগর সাধু ঠাকুর যশোরের অভয়নগরের সমস্যার সমাধানকল্পে চেষ্টা করেছেন এবং প্রশান্ত বাবু চেষ্টা করে পোলিটিক্যাল, সামাজিক মানুষজনদেরকে ম্যানেজ করে দিলেন যে, ঝামেলাটি যাতে উত্তরিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, এই সমস্যাটির শুরু অভয়নগরের মতুয়া গোঁসাইয়ের পিতা মারা যাওয়াকে কেন্দ্র করে। সেখান থেকে শুরু এবং ৫ই বৈশাখের মতুয়া সম্মেলনে যার প্রভাব এসে পড়েছে। সাগর সাধু ঠাকুর মতুয়া সম্মেলনকে হিন্দুদের অনুষ্ঠান মনে করেন। অভয়নগরের মতুয়া সম্মেলন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “সেই মিটিংয়ে প্রশান্ত বাবু তো আছেনই, আমি ওই যশোরের দীপঙ্কর, যতন দাস, যারা চেনেন, অনেকেই চেনবেন, উনাদেরকে ওখানে উদ্বুদ্ধ করলাম, যাবেন, দেখবেন, রক্ষা করবেন, অন্যদের কাছে যাতে মেসেজ না যায় যে, হিন্দুদের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
--- প্রথমত অনুষ্ঠানটি মতুয়াদের ছিল। এখানে পোলিটিক্যালি মানুষদের ম্যানেজ করার কী দরকার? পোলিটিক্যাল লোকজন এখানে কেনো নাক-গলাতে আসবে? দ্বিতীয়ত, এটা মতুয়াদের অনুষ্ঠান। তাহলে সামাজিক মানুষজন এর বিরোধিতা কেনো করবে? সাগর সাধু কীসের সমাধান করেছেন? সামাজিক মানুষজন বিরোধিতা করেছেন, মানে যারা বিরোধিতা করেছেন, তারা মতুয়া নয়, তাহলে তারা কী? নিঃসন্দেহ তারা হিন্দুসমাজভুক্ত। আচ্ছা, আপনারা ভাবুন তো হিন্দুরা যদি মতুয়াদের তাদের সমাজের মনে করে, তবে বিরোধিতা কেন করবে? তৃতীয়ত সাগর সাধু মনে করেন ‘মতুয়া মহৎসব-মতুয়া সম্মেলন’ হিন্দু সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু মতুয়া মহোৎসব বা সম্মেলন কী করে হিন্দুসংস্কৃতি হয়? কারণ এই বক্তব্যের অন্যত্র তিনি বলেছেন, “কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি যদি হিন্দু হয়, সেই সিন্ধু নদের উপত্যকা হতে আজকে যদি হোটেল অ্যাম্বাসেডর পর্যন্ত আমরা সেই একই ধারা নিয়ে পৌঁছাতে পারি, এভাবে যদি আমাদের হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে আগামী হাজার বছর কেনো নয়।” তার মতে হিন্দু সংস্কৃতি সিন্ধু নদের উপত্যকা হতে একই ধারায় বাহিত হয়ে আসছে। মতুয়া সম্মেলনের বা মহোৎসবের বয়স কত? হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবিতকালে তারই নির্দেশনায় এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রথম মহোৎসব হয় ভক্তা নায়েরির বাড়িতে। সেই মহোৎসবও এখনকার মত ছিল না। তখনও নিশান-ঢাক-ঢোল নিয়ে মহোৎসব করার রীতি চালু হয়নি, কারণ নিশান সংস্কৃতি গুরুচাঁদ ঠাকুরের সময় প্রচলিত হয়েছে এবং তারকচাঁদ প্রথম নিশান প্রদান করেন ওড়াকান্দিতে অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে। তাহলে সাম্প্রতিক সময়ের এই সংস্কৃতি কীভাবে সিন্ধু নদের তীরের হিন্দু সংস্কৃতি হয়? এটা কোনওভাবেই হিন্দু সংস্কৃতি নয়, এটা মতুয়া সংস্কৃতি। সাগর সাধু মতুয়া সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতি বলার কে?
৪। কাঠালিয়ার ঘটনাকে সাগর সাধু সেখানকার পূজা পরিষদ ও ঐক্য পরিষদের দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “কাঠালিয়াতে বিরাট বড়ো ধরনের সমস্যা হলো। সেটি কী, কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে, একজন সুশীল সাধু নামে একজন ভদ্রলোক মারা গেলেন। সুশীল সাধুর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সেখানকার পূজা পরিষদ এবং ঐক্য পরিষদের সাথে একটি বিরাট দ্বন্দ্ব তৈরি হলো, এবং একটি বিশৃঙ্খল জায়গায় চলে গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাণাদার সঙ্গে কথা বলে, ---দার সাথে কথা বলে, কাজলদার সাথে কথা বলে, আরও কিছু ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলে, ওখানকার লোকাল যারা আছে, তাদের সাথে কথা বলে একটি সমন্বয়ের জায়গায় আনার চেষ্টা করলাম এবং সমন্বয় হলো।”
--- আচ্ছা। সুশীল সাধু মারা গেলেন। তিনি কোন মতাবলম্বী ছিলেন? মতুয়া মতাবলম্বী তো? তিনি যদি মতুয়া মতাবলম্বী হন, তবে মতুয়া মতে তার শ্রদ্ধা (সাগর সাধুর মতে শ্রাদ্ধ) অনুষ্ঠান করতে সমস্যা কোথায়? এখানে পূজা পরিষদ বা ঐক্য পরিষদের সংযুক্তিই বা কোথায়? তিনি রাণাদা-সহ কার কার সাথে কথা বলে সমন্বয় করেন। এখানে সমন্বয়ের আছেটা কী? মৃতব্যক্তির উত্তরসূরি বা উত্তরাধিকারী যেভাবে পারে তার শ্রদ্ধা বা শ্রাদ্ধ করবে। তার উত্তরসূরি বা উত্তরাধিকারী যদি একাধিক হয় এবং তারা যদি একাধিক মতের হয়, তবে একাধিক মতেই হতে পারে। একজন আরেকজনকে তার মতে করতে বাঁধা দেবার কে? কার সাথে কীসের সমন্বয় হলো, সেটাই বুঝলাম না।
৫। সাগর সাধু কটাক্ষ করে প্রশ্ন রেখেছেন যে, “শুনি মতুয়া মতে বিবাহ, শুনি মতুয়া মতে শ্রাদ্ধ, আমার অন্তরটা ফেটে যায়, শ্রাদ্ধ আর বিবাহের মত সৃষ্টি করার জন্য কী প্রভু হরিচাঁদের আবির্ভাব হলো? কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখি, চারিদিকে মতুয়া মতে বিবাহ আর শ্রাদ্ধ হচ্ছে।”
--- মতুয়ামতে বিবাহ ও শ্রাদ্ধের কথা শুনে সাগর সাধুর অন্তর ফেটে যায়। এমন অন্তর ফেটে যাওয়াই ভালো। সাগর সাধুর অন্তর কিন্তু তখন ফাটে না, যখন হরিচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশ অমান্য করে তাকে সমাধি করার পরিবর্তে পুড়িয়ে ফেলা হয়, এমন খবর শুনে। অন্তর ফাটে মতুয়ামতে বিবাহ ও শ্রাদ্ধের কথা শুনে। হরিচাঁদ ঠাকুর বিবাহ আর শ্রাদ্ধের মত সৃষ্টি করার জন্য আসেনি, ও কাজ তো আমরাই করব। কারণ হরিচাঁদ ঠাকুর একটা আলাদা সম্প্রদায় দিয়েছেন। আমরা সেই সম্প্রদায় ‘মতুয়া সম্প্রদায়’। আলাদা একটা সম্প্রদায়ের আলাদা ও স্বতন্ত্র একটা ধর্ম হতেই পারে, আমরা সেই ধর্মের লোক। আমাদের ধর্ম ‘মতুয়াধর্ম’। মতুয়াধর্মের মতুয়া সংস্কৃতি অন্যধর্মের সংস্কৃত থেকে আলাদা হবে, এটাই স্বাভাবিক। হিন্দুভাবাশ্রিত বা হিন্দুভাবাপন্ন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য এটা অত্যান্ত জরুরি। ধর্মের বাহক ধর্মজাত সংস্কৃতি। ধর্মজাত সংস্কৃত স্বতন্ত্র না হলে স্বতন্ত্রধর্ম প্রতিষ্ঠা পায় না।
৬। সাগর সাধু বলেছেন, “ভারতবর্ষ থেকে ডি.এল.বি. ঠাকুর কী লিখবে, গোপালগঞ্জ থেকে আমাদের শ্রদ্ধেয় হরপ্রসাদ বাগচি বাবু তিনি তার আপন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কী বলবেন, এটি কোনো কথা নয়।”
--- আচ্ছা, আপনারাই বলুন, শ্রদ্ধেয় ডি.এল.বি. ঠাকুরের কথা যদি কথা না হয়, শ্রদ্ধেয় হরপ্রসাদ বাগচির কথা যদি কথা না হয়, তবে কথা হবে কার কথা? সাগর সাধু এরও উত্তর দিয়েছেন তার বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, “উপস্থিত শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ----- আমাদের যারা নেতৃবৃন্দরা রয়েছেন, আপনারা রয়েছেন, বৃহত্তর হিন্দু সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে আজকে এই বিবাহ করা আর পিতা-মাতা মরে যাওয়া সবচেয়ে বড়ো পাপে পরিণত হয়েছে। এই পাপ থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে, শুধু মতুয়ারা নয়, সবাই মিলেমিশে।” উক্ত সেমিনারে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের কথাকে সাগর সাধু কথা বলে উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, উক্ত সেমিনারে সাগর সাধু ব্যতীত আর কোনো মতুয়ানেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন বলে মনে হয় না। ওখানে ছিল কারা? প্রায় সকলেই অমতুয়া। মতুয়াদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সিদ্ধান্ত সাগর সাধু কীভাবে অমুয়াদের হাতে দিতে পারেন? অমতুয়াদের মধ্যে থেকে কে মতুয়াদের পক্ষে এখনও পর্যন্ত একটা কথা বলেছে, আমার জানা নেই। আপনারা জানেন কী?
৭। সাগর সাধু নিজেদের পূজাপার্বণ নিজেরাই করার পক্ষে। তার এই মতের পক্ষে সভায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দের সাক্ষ্যও তিনি আদায় করে নিয়েছেন।
--- তিনি কতটা নিজেদের কাজ নিজে করার পক্ষে? তিনি উদাহরণ টেনে বলেছেন, “বিভিন্ন সমাজ-বিভিন্ন ধর্ম-বিভিন্ন মত-বিভিন্ন পথের মানুষজন আপনারা এখানে এসেছেন, যদি সম্ভব হয়, আমরা শ্রীল প্রভুপাদকে তো বসিয়ে রেখে সমাধি করতে দেখেছি, আমরা রামকৃষ্ণ মিশনের আধিকারিকবৃন্দকে নিজেদের পূজাপার্বণ নিজেদের মতো করে করতে দেখেছি, নিশ্চয়ই আপনারা জানেন, আমাদের এখানে যে গোঁসাই মহারাজ আছেন, আমার কাকায় আছেন, আমরা, ঘটনা ঠিক তো (কাকা বলে কথিত ব্যক্তির দিকে নির্দেশ করে)? নিজেরা নিজেরা করা যায় তো (কাকার মাথা নেড়ে সম্মতি প্রদান)?” ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদের বসিয়ে সমাধি দেওয়াকে ইসকনের নিজ মতে কাজ বলতে পারেন, রামকৃষ্ণ মিশনের নিজেদের পূজা করাকে নিজ মতে বলতে পারেন, কিন্তু মতুয়া মতে বিবাহ ও শ্রদ্ধা (শ্রাদ্ধ) করাকে মতুয়াদের নিজ মত বা মতুয়া মত বলতে সাগর সাধু কুণ্ঠিত হন। কী অদ্ভুত! তাই না। তাহলে সাগর সাধুর মতে নিজের পূজা নিজে করার অর্থ কী? আমার কাছে মনে হচ্ছে, তার কাছে নিজের পূজাপার্বণ নিজে করার অর্থ হচ্ছে মতুয়ারা নিজেদের শ্রাদ্ধ বা বিবাহ বা পূজা মতুয়ারা করতে পারবে, কিন্তু নিয়ম বদলাতে পারবে না; ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রের ওই অং বং চং মন্ত্র পড়ে, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রের নির্দেশমত করতে পারবে। কিন্তু শাস্ত্রের সূক্ষ্ম কূটকাচালি জানা মতুয়ারা তো এই মত পছন্দ করে না। ব্রাহ্মণ্যবাদের কিংবা তাদের শাস্ত্রের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মতুয়ারা নিজস্ব ও অধিকতর যুক্তিসিদ্ধ সংস্কৃতির পক্ষে তারা। এখানে বাঁধা দেওয়ার সাগর সাধু কে? তার পছন্দ না হয় করবেন না, অন্যদের বাঁধা কেনো দিবেন?
যাই হোক। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মুক্তির আহ্বান’ সংগঠনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ। আমি তাদের উদ্দেশ্যকে সমর্থন করি। তাদের সেমিনারের উদ্দেশ্য “বৃহত্তর হিন্দু সমাজ গঠনের পথে অন্তরায় ও সমাধানের উপায় উদ্ভাবন”। তাদের উদ্দেশ্য সাধনে মতুয়ারাও আশাকরি সহযোগিতা করবেন বলেন আশা করতে পারি, কিন্তু তা নিজস্ব সংস্কৃত বিসর্জন দিয়ে নয়, নিজেদের সংস্কৃতিকে কটাক্ষ করে নয়। ‘মুক্তির আহ্বান’ সংগঠনটি সমন্বয়ের কাজ করতে চায়। বিভিন্ন মত-পথের মধ্যে সমন্বয় করতে হলে প্রতিটি মত-পথের কিছু কিছু ছাড় দিতে হয়, আবার এই ছাড়ের বিপরীতে কিছু কিছু প্রাপ্তি অবশ্যই থাকতে হয়; নইলে সমন্বয় হয় না। সাগর সাধু মতুয়াদের, বিশেষত সংস্কারপন্থী মতুয়াদের যেভাবে কটাক্ষ করেছেন, বস্তুত মতুয়াদের বিষয়ে যেসব বিষয়ে ছাড় দিতে চেয়েছেন, তা সকলেই বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু এই সমন্বয়ের মাধ্যমে মতুয়াদের প্রাপ্তিটা কী? সেটা বুঝতে পারিনি। হিন্দুর সংখ্যা বৃদ্ধি ব্যতীত(!!)। সর্বোপরি এরকম একটা সেমিনারে মতুয়াদের পক্ষ হতে সাগর সাধুকে মতুয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন কে করল? কার প্রছন্ন বা প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় এরকম একটা সেমিনারে মতুয়াদের সম্পর্কে সাগর সাধু মতুয়াদের সম্পর্কে এতটা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে পারেন। বিশ্বের হিন্দু সমাজ, বিশেষত বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের বিভিন্ন দল-উপদল-সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়ের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা তাদের শাস্ত্রে, ধর্মজাত সংস্কৃতিতে। জাতিভেদ-বর্ণভেদ তার মধ্যে প্রধানতম। ‘মুক্তির আহ্বান’ সংগঠনের নিকট আমি আবেদন জানাচ্ছি বা প্রস্তাব রাখছি যে, আপনারা হিন্দুধর্মীয় শাস্ত্রকে সংশোধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। শাস্ত্র থেকে জাতিভেদ-বর্ণভেদ সম্পর্কিত এবং ধর্মজাত বিভিন্ন সংস্কৃতি যেমন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ, অশৌচ ইত্যাদি বিধান মুছে ফেলে দিন। এসব করতে পারলে তবেই আপনাদের উদ্দেশ্য সাধন হবে, তার আগে কোনওভাবেই পারবেন না আপনাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে। শাস্ত্র থেকে নানাবিধ বর্ণ-জাতির জন্য এসব বিভিন্ন ধরনের বিধান মুছে একক বিধান সর্বমান্য একক বিধান তৈরি করুন। তবেই সকলে তা মানতে পারে, তার আগে নয়। মুখের কথায় কাজ হবে না। শাস্ত্র সংশোধন না করে বিধান তৈরি করলে শাস্ত্রের রেফারেন্সে তা বাতিল হয়ে যাবে, আবার দ্বন্দ্ব তৈরি হবে।
সংস্কারপন্থী মতুয়াদের আমি আহ্বান জানাই, আপনারা সাগর সাধুর বাতলে দেওয়া পথ অনুসরণ করেই তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবাদটি করতে পারেন। এতে মতুয়াদেরও খুবই উপকার হবে। সাগর সাধু তার বক্তব্যে বলেছেন, “আপনারা প্রত্যেকটি গ্রামের একটি সমাজ, হিন্দু সমাজ আজও রয়েছে, এই সমাজটি কিন্তু যায়নি। আপনারা টিম করে, দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে প্রত্যেকটি সমাজে গিয়ে এক-একটি বৈঠক করবেন। আমার এই প্রস্তাবটি কি এই বৃহত্তর সমাজে গৃহীত হবে?। যদি এক-একটি সামাজিক বৈঠক হয়, সমাজের কর্তাব্যক্তি এবং যুবকদের-তরুণদের যদি বোঝানো যায়, ধর্ম আমার তো রয়েছেই, আমার কর্মটা কোথায়, আমার সংঘাতটা কোথায়, আমার লড়াইটা কোথায়- সেই জায়গাতে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। সমাজের মধ্যে যদি পরিবর্তন আসে, বিবাহ থেকে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান, যে সমস্ত বাঁধা নিয়ে, জাতাজাতি নিয়ে আজও সমাজ পিষ্ঠ; সেই সমস্ত জায়গা থেকে একেকটি সমাজকে আমরা উঠিয়ে আনতে পারি, যদি ‘মুক্তির আহ্বান’ পারে; আজকে একটা, কালকে একটা, পরশুদিন একটা, তারপরে একটা; এই একটা একটা করেই বাংলাদেশের পরিবর্তন আনা সম্ভব।” সংস্কারপন্থী মতুয়ারা, আপনারাও এরকম দল-উপদলে ভাগ হয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছোট ছোট সভা করে সেখানকার সমস্যাবলীর সমাধান করতে পারেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর জাগরণী সভা করতেন। আপনারাও জাগরণী সভার আদলে সভা করতে পারেন। বিশেষ করে, মতুয়া সমাজের বড়ো অংশের ধারক-বাহক বিভিন্ন মতুয়া গোঁসাই, সাধু ও অন্যান্যজনের সঙ্গে ছোট ছোট করে সভা করে তাদের মতুয়া দর্শনের মূল তাৎপর্য বুঝাতে হবে। বড়ো বড়ো সভা করলে কাজ হবে না। সমস্যাভিত্তিক কিংবা নিয়মিত সভা করতে হবে। তবেই সকল মতুয়ারা বুঝতে পারবে তাদের স্বতন্ত্রতা।
এ আমার নিজস্ব মতামত। আমি সকল মতুয়াদের প্রতিনিধি নই। তাই আমার নিজস্ব মতামতকে বৃহৎ মতুয়া সমাজের মতামত বলে ধারণা করবেন না। তবে যদি আমার মতের সঙ্গে ঐক্যমত হন, তবে অবশ্যই আমার লেখা সার্থক। সকলকে ধন্যবাদ।