নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
লঘু-ত্রিপদী
গোস্বামী লোচন, প্রেম মহাজন,
বৈষ্ণব সুজন যিনি।
গ্রাম নড়াইলে, জনম লভিলে,
পূর্বে ছিল ভৃগুমুনি।।
নাম চূড়ামণি, সাধু শিরোমণি,
লোচনের হন পিতা।
তুলসী সেবন, শ্রীকৃষ্ণ ভজন,
কহিতেন হরিকথা।।
তাঁহার নন্দন, হ’ল পঞ্চজন,
করিতেন কৃষিকার্য।
তীর্থে তীর্থে বাস, প্রায় বারমাস,
গৃহকার্য ক’রে ত্যজ্য।।
পাঁচটি নন্দন, সকলে সুজন,
শ্রীকৃষ্ণ ভজন করে।
পঞ্চ সহোদর, ভজনে তৎপর,
পিতা যান লোকান্তরে।।
পাঁচের প্রবীণ, পরিল কৌপিন,
না করিল পরিণয়।
হ’য়ে গৃহ ত্যাগী, হইল বৈরাগী,
ভিক্ষা মাগী সদা খায়।।
কিছু দিন পরে, গ্রাম শিবপুরে,
আখড়ায় বাস করে।
যত সব লোকে, তার ক্রিয়া দেখে,
ঠাকুর বলেন তারে।।
লোচন গোঁসাই, দেখে শুনে তাই,
ভাই গেল গৃহ ত্যাজি।
আমি কি সুখেতে, থাকিব গৃহেতে,
সংসার ভোজের বাজী।।
বাল্যকালাবধি, করে নিরবধি,
হাই ছাড়ে কৃষ্ণনাম।
কৃষ্ণ বলে সদা, আর বলে দাদা,
কেন মোরে হ’লে বাম।।
ডাকি একদিনে, ভাই তিন জনে,
কহেন মধুর ভাষে।
আমিও বৈরাগী, হই গৃহ ত্যাগী,
সবে সুখে থাক বাসে।।
লোচন জননী, নামেতে আছানী,
কথা শুনে মাতা কয়।
বাছারে লোচন, শুনিয়া বচন,
জীবন জ্বলিয়া যায়।।
জনক তোমার, হ’ল লোকান্তর,
সহোদর তব জ্যেষ্ঠ।
দুঃখিনী দেখিয়া, গিয়াছে ছাড়িয়া,
অন্তরে অনন্ত কষ্ট।।
কিছু দিন পর, মাতা লোকান্তর,
সাধু পেল অবসর।
পরিয়া কৌপিন, হৈল উদাসীন,
দীনহীন ক্ষুদ্রতর।।
মেগে খায় ভিক্ষা, নাহি দীক্ষা শিক্ষা,
নিজেই কৌপিনধারী।
হা গুরু বলিয়া, ডাক ছেড়ে দিয়া,
হইল দীন ভিখারী।।
কালো রূপ আলো, বরণ শ্যামল,
নীল কমল শরীর।
দ্বিবাহু লম্বিত, অতি সুললিত,
নাভীপদ্ম সুগভীর।।
শ্রীরামলোচন, কহে কোন জন,
নামে লোচন প্রকাশ।
কখন কখন, কহে কোন জন,
শ্রীরামলোচন দাস।।
হা গুরু গোঁসাই, বলে ছাড়ে হাই,
কখন কহিত দাদা।
মোর এ সময়, থাকিবা কোথায়,
হৃদয় থাকিও সদা।।
সাধু লোকে সব, বলেন বৈষ্ণব,
হইল বৈষ্ণবোপাধি।
কাটি কর্মভোগ, ত্যজি ন্যাসযোগ,
মহারোগ নিল ব্যাধি।।
হস্ত পদাঙ্গুল, হ’ল স্থুল স্থুল,
ক্ষত হ’য়ে গেল খসি।
ছিল মাত্র রেখা, কাষ্ঠের পাদুকা,
পায় বাঁধে দিয়া রসি।।
বৃদ্ধ পদাঙ্গুল, ছিল মাত্র মূল,
হস্তের তর্জনী মূর্দ্ধ।
শ্রীকর যুগলে, চতুর আঙ্গুলে,
র’ল মাত্র অর্ধ অর্ধ।।
ক্লেদ শুকাইল, ক্ষত সেরে গেল,
রহে চিহ্ন অন্যাঙ্গুল।
নাসা চক্ষু লাল, বদন অমল,
দন্ত যেন কন্দ ফুল।।
মুখে নাহি ক্ষত, কমল শোভিত,
অধরে মধুর হাসি।
অধরোষ্ট প্রান্তে, কুন্দ সম দন্তে,
হাসিতে খসিত শশী।।
শরীর মাঝেতে, স্থানেতে স্থানেতে,
ইচ্ছায় করিত ক্ষত।
এক ঘা সারিত, আর ঘা করিত,
রক্ত ক্লেদ বহির্গত।।
কখন নৌকায়, গৃহস্থ আলয়,
যান কখন কখন।
ক্ষুধার সময়, হইত যথায়,
তথা করিত ভোজন।।
ভিক্ষাপাত্র হাঁড়ি, লয়ে বাড়ী বাড়ী,
করিতেন সদা ভিক্ষা।
ক্ষুধার্ত হইলে, খাইতে চাহিলে,
কেহ না করে উপেক্ষা।।
হিন্দু কি যবনে, ঘৃণা নাহি মনে,
ভোজনে ছিল রীতি।
যে করে আদর, খায় তার ঘর,
বিচার নাহিক জাতি।।
লোহাগড়া বাসী, পীতাম্বর ঋষি,
খুশী হ’য়ে দিত খেতে।
অভিমান শূন্য, খেত তার অন্ন,
সে ধন্য হ’ল ভক্তিতে।।
ছিল এক ভক্তা, নাম তার মুক্তা,
জাতি বেবা’জের মেয়ে।
ভকতি করিত, চরণ ধরিত,
খাইত সে বাড়ী গিয়ে।।
ঋষি পীতাম্বর, ভোজনে তৎপর,
ঘুচে গেল দৈন্য দশা।
শ্রীকৃষ্ণ বলিয়ে, বেড়া’ত কাঁদিয়ে,
ত্যজিয়ে জাতির পেশা।।
তর্জনী মধ্যয়ে, হাত বাঁধাইয়ে,
অর্ধ দ্বি অঙ্গুলী ধরে।
অন্নেতে ব্যঞ্জন, করিয়া মিশ্রণ,
তুলিয়া দিত অধরে।।
মুকুতা বেদেনী, দৈন্য ছিল ধনী,
দোকানী সে মনোহারী।
অদৈন্য সংসার, হইল তাহার,
গোস্বামীর সেবা করি।।
জয়পুর গ্রামে, ওয়াছেল নামে,
জাতিতে মুসলমান।
গিয়া তার ঘরে, ভোজনাদি করে,
বাড়িল তাহার নাম।।
সে হ’ল ফকির, লোকে বলে পীর,
জিগীর মারিয়া ফেরে।
লোচন বলিয়া, ডাক ছেড়ে দিয়া,
নাম দিয়া রোগ সারে।।
ত্যজে বেদাচার, জাতি কুলাচার,
বৈষ্ণব আচার ত্যাগী।
তারকের আশা, মানস পিপাসা,
স্বামীর চরণ লাগি।।