নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
ভূমিকা
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থ মহাপ্রভুর কৃপায় বহুদিন পরে জনসমাজে প্রকাশিত হইল। এই গ্রন্থে যাহা লেখা হইল, তাহাই মহাপ্রভু শ্রীশ্রীহরি-ঠাকুরের জীবনী। ইনি ১২১৮ সালের ফাল্গুণ মাসে, কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে, “শ্রীশ্রীমহা-বারুণীর দিনে,” “ব্রাহ্ম-মুহূর্তে,” জন্ম গ্রহণ করেন। এবং ১২৮৪ সালের ২৩শে ফাল্গুণ বুধবার নিত্যধামে গমন করিয়াছেন।।
মহাপ্রভুর লীলার প্রারম্ভে, প্রথমতঃ প্রভুপাদ শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস ও শ্রীযুক্ত দশরথ বিশ্বাস মহাশয় দ্বয়, প্রভুর লীলা প্রকাশ মানসে অত্র গ্রন্থ প্রণেতা শ্রীযুক্ত কবি-রসরাজ মহাশয়কে, লেখক পদে নিযুক্ত করিয়া, অত্র লীলার কতকাংশ লিখিয়া শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি গিয়া, মহাপ্রভুকে দেখাইয়া ছিলেন। তখন মহাপ্রভু গ্রন্থ লিখিতে নিষেধ করেন। তত্রাপি মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস মহাশয়, গ্রন্থ লিখিতে ইচ্ছুক হইলেন। তখন মহাপ্রভু বলিলেন, মৃত্যুঞ্জয়। তুমি যদি এই লীলা গ্রন্থ প্রকাশ কর, তাহা হইলে তোমার গলিত-কুষ্ঠ হইবে; এবং হস্ত পদাদির অঙ্গুলী স্খলিত হইবে। তচ্ছ্রবণে বিশ্বাস মহাশয় অতি কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া বলিলেন প্রভো! আপনার লীলাগীতি লিখিতে যদি আমার গলিত-কুষ্ঠ হয়, তাহা হইলে, আমি আমাকে কৃতার্থ, ও আমার জীবন স্বার্থক হইয়াছে বলিয়া মনে করিব। সে ত আমার জীবনের “লীলা-গীতি” লেখার পরম পুরষ্কার; এবং কর্ম জগতের মানব দেহের অতি মূল্যবান আভরণ। অতএব আমি লীলা-গীতি, লিখিব। কিন্তু, দৈব-নির্বন্ধন, লিখিত লীলা-গ্রন্থ শ্রীধাম হইতে হারাইয়া যায়। সুতরাং বিশ্বাস মহাশয় দ্বয়, গ্রন্থ লিখিতে নিরস্ত হইলেন। কিয়দ্দিন পরে, আন্তরিক গাঢ় অনুরাগের উত্তেজনায়, উক্ত বিশ্বাস মহাশয় দ্বয়, পুনরায় গ্রন্থ লিখিতে, কবি-রসরাজ মহাশয়কে, অনুরোধ করেন; তদুত্তরে কবি-রসরাজ মহাশয় বলিলেন, গোস্বামিন্! আমি লেখা জানিনা, পড়া জানিনা, অতি মূর্খ, অতি মূঢ়’ যাহা জানি তাহা বলিবার নয়। বিশেষতঃ আমার লেখা জগতে কে মান্য করিবে? অতএব গ্রন্থ লিখিতে, অযোগ্য ও অক্ষম বলিয়া আমাকে ক্ষমা করুণ। তচ্ছ্রবণে বিশ্বাস মহাশয়দ্বয়, পুনর্বার কবি-রসরাজ মহাশয়কে বলিলেন, তারক! যদি চ, তুমি মূর্খ হও, প্রভুর লীলাত আর মুর্খ নয়। অধিকন্তু, আমরা দুজন তোমাকে আশীর্বাদ করিলাম; তুমিই, এই লীলা গ্রন্থ লিখিতে, পারিবে। তথাপি তিনি নিজেকে, এই বৃহৎকার্যে অযোগ্য মনে করিয়া; নিরস্ত থাকিলেন। অতঃপর অনেক দিন পরে, একদা রাত্রি-যোগে স্বপ্নাদেশে, বাক্য বিনোদিনী দেবী-সরস্বতী আসিয়া কবি-রসরাজ মহাশয়কে বলিলেন; তারক! বহুদিন পূর্বে, শ্রীশ্রীধাম ওঢ়াকাঁন্দী হইতে, তোমাদের কৃত, প্রভুরলীলা গ্রন্থ তখন লীলা প্রকাশের অসময় বলে, তাহা আমার নিকটে রাখিয়া ছিলাম; এই তোমাদের সেই গ্রন্থ লও, এখন প্রভুর লীলা প্রকাশ কর, বলিয়া সেই গ্রন্থ দিয়া যান। তত্রাপি তিনি লিখিতে নিরস্ত থাকেন। পরে নিত্যানন্দ শক্তি বিশিষ্ট স্বামী মহানন্দ পাগল, অহরহ সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া, বারংবার অনুরোধ করায় ও তিনি গ্রন্থ লিখিলেন না। কিয়দ্দিন গত হইলে, পরলোক গত ভাবময় প্রভুপাদ, গোস্বামী গোলোকচাঁদ উন্মত্তাবেশে, একদা শেষ নিশাতে স্বপ্নাদেশে ভীষণ “নৃসিংহ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া” কবি-রসরাজ মহাশয়ের বক্ষঃপরে নখ বাধাইয়া দিয়া” বলিলেন। “হয়ত প্রভুর লীলা গ্রন্থ দে,” “নচেৎ তোর বক্ষঃ চিরিয়া রুধীর পান করিব।” তখন কবি-রসমাজ মহাশয় অগত্যা স্বীকার করিলেন। এবং চক্ষুরুন্মিলন করতঃ দেখিলেন, যে, সূর্যোদয় হইয়াছে। পরে তিনি “লীলা-গীতি” লিখিতে আরম্ভ করিলেন। স্বামী মহানন্দ পাগলের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, তিনি মুদ্রিত “শ্রীশ্রীহরি-লীলামৃত” দেখিবেন। গত ১৩১৪ সালের চৈত্র মাসে ৺মহানন্দ স্বামী প্রভুর আনুসঙ্গ বা পরলোক গত হইয়াছেন। তখন গ্রন্থ অসম্পুর্ণ থাকায় মুদ্রিত হয় না। গ্রন্থ লেখা সমাপ্তি পরে, ও, এই গ্রন্থ মুদ্রা-অভাবে মুদ্রিত হয় না। সুতরাং কবি রসরজ মহাশয় ও তাহার অযোগ্য শিষ্য হরিবর সরকার, দীন-ভিখারী হইয়া ভিক্ষা করায়, “ভিক্ষা লব্ধ” কিছু অর্থ সংগৃহীত হইয়াছিল। গত ১৩২১ সালের ১লা অগ্রহায়ণ গুরুপাদ কবি-রসরাজ মহাশয়, ইহজগতের মায়া-মমতা বিসর্জন দিয়া, প্রভুর সেবা কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন।
সুতরাং, নানা কারণে, প্রধানতঃ অর্থানটনে, গ্রন্থ মুদ্রিত হইল না। অতঃপর ওঢ়াকাঁদির সম্প্রদায় ভুক্ত সাধুপাধিক উদার-চেতা খুলনা জিলান্তর্গত লক্ষীখালী-নিবাসী শ্রীযুক্ত গোপালচন্দ্র হালদার মহাশয় সম্পুর্ণ ব্যয় ভার বহন করিয়াছেন। তাহার স্বেচ্ছাদান ও উদার চরিত্রে মহাপ্রভুর লীলা-গীতি এতদিনে পরিসমাপ্ত হইল। অত্র গ্রন্থে মহাপ্রভুর জন্মানুষ্ঠান; জন্ম, প্রভুপাদ শ্রীশ্রীরামকান্ত গোস্বামী কর্তৃক ভক্তি-ভাবের নব অবতারণা, ও প্রভুর বাল্য লীলা, বিবাহ, গার্হস্থ্য-ধর্ম প্রকাশ, প্রভুত্ব প্রকাশ, উপদেশপূর্ণ-রচনাবলী, লীলাপ্রকাশ প্রাচুর্য, কৃষিকার্য, বাণিজ্য, শ্রীক্ষেত্র হইতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ দেব কর্তৃক প্রসাদ প্রেরণ, এবং প্রভু ভক্তের উদার চরিত্র; প্রভৃতি লিপিবদ্ধ হইল।
অপিচ-
এই গ্রন্থে অনেক আশ্চর্য ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছে। অধুনা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে, আশ্চর্য ঘটনাবলীর সত্যতার বিশ্বাস স্থাপন করিবার অক্ষমতা দৃষ্ট হয়। এই সম্প্রদায় কে আমার বক্তব্য এই;-
এই আশ্চর্য বিচিত্রতা পুর্ণ জগতের বিশেষতঃ ধর্ম জগতের ঘটনাবলী, মানুষের চক্ষে, সমস্তই আশ্চর্য পূর্ণ। ধর্ম জগতের ইতিহাসে, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই, অতীব আশ্চর্য ঘটনার বিবরণ দৃষ্ট হয়। শ্রীশ্রীমহাপ্রভু চৈতন্য দেবের জীবনের ঘটনাবলী, সমস্তই আশ্চর্য ঘটনা পূর্ণ। এমন কি পাশ্চাত্য জগতের ধর্ম প্রভু যীশুর জন্ম জীবনী ও কার্য কলাপ অত্যাশ্চর্য ঘটনায় পরিপূর্ণ। কিন্তু তাই বলিয়া এই সমস্ত ঘটনাবলীর, সত্যতায় কেহই সন্দিহান হন না।
আরও একটা কথা।
মানুষের শক্তি ও জ্ঞান অতি ক্ষুদ্র। সেই জ্ঞানকে জাগতিক ঘটনাবলীর, সত্যাসত্যের একটা বিচার বলিয়া মানিয়া লওয়া যাইতে পারে না। বরং এই সমস্ত নূতন নূতন ঘটনাবলী মানুষের জ্ঞান ও শক্তিকে, উত্তরোত্তর পরিবর্তিত করিতেছে, ভবিষ্যতে আরও করিবে। কবি-রসরাজ মহাশয় মহাপ্রভুর সাময়িক শিষ্যগণের প্রমুখাৎ যে সমস্ত ঘটনাবলী শ্রুত হইয়াছেন, তাহা এবং তিনি প্রভুর সঙ্গে থাকিয়া চাক্ষুস যাহা দেখিয়াছেন, তাহা, ঠিক সেই ভাবে এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে। এই গ্রন্থের ঘটনা সম্বন্ধে যে স্থানে যে ক্রিয়া হইয়াছে; সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া এ বিষয় প্রমাণ করিলে, যতটুকু লেখা হইয়াছে, তদধিক রূপে প্রমাণিত-হইবে। এই গ্রন্থ মহাপ্রভুর শিষ্যগণের মধ্যে যে অতীব আদরণীয় হইবে, এ বিষয় অনুমাত্র সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ মহাপ্রভুর শিষ্য সম্প্রদায়ের বহির্ভুক্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় ও এই গ্রন্থে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় অবগত হইবেন। কিমধিক মিতি-
নিবেদক
শ্রীহরিবর সরকার