নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
পয়ার
ওঢ়াকান্দি অবতীর্ণ ভব কর্ণধার।
স্বর্গ মর্ত ব্যাপি চলে প্রেমবন্যা তার।।
পূর্ব বঙ্গে হরিনাম না ছিল প্রচার।
ক্রমে ক্রমে ঘরে ঘরে নামের সঞ্চার।।
কেহ রোগে কেহ শোকে ধনের লাগিয়া।
পুত্র হীন পুত্র জন্য মিলিল আসিয়া।।
কেহ যদি হরিনাম কখন বলিত।
চমকিত হ’য়ে সবে গালাগালি দিত।।
মানুষ মরিলে যাহা বলে তিন বার।
খামাকা বলিস তাই বাড়ীর উপর।।
কি সাহস তোর কিছু ভয় নাই মনে।
মরিতে বাসনা তোর হ’ল কি কারণে।।
পরে পূর্ব বঙ্গে শোধিবারে ঋণ ধার।
যশোমন্ত রূপে হরি হ’ল অবতার।।
ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে প্রচারিল নাম।
কিবা দিবা বিভাবরী নাহিক বিরাম।।
হরিবল হরিবল হরিবল হরি।
উচ্চৈঃস্বরে নাম করে ব্যোম ভেদ করি।।
হাসে কাঁদে নাচে গায় হইয়া বিভোলা।
নাম শুনে রূপ দেখে কেহ বা মাতিলা।।
কেহ বলে মতুয়া কেহ বা হরিবোলা।
কেহ করে গালাগালি হরি বলা শালা।।
গালাগালি পরে ক্রমে ঢলাঢলি হয়।
ক্রমে দেশ ডুবে গেল প্রেমের বন্যায়।।
পুত্র পেয়ে হরিবোলা হইল আনন্দ।
ওঢ়াকান্দি আসে যায় করে প্রেমানন্দ।।
কভু বা সস্ত্রীক কভু সপুত্রক যান।
প্রভু নামে সংকীর্তন বেঁধে করে গান।।
সব লোকে বলে তুমি ওঢ়াকান্দি যাও।
যাহা লও তাহা দিয়ে বাড়ী এসে খাও।।
সব লোক যায় যত দ্রব্য ল’য়ে সাথে।
সব দ্রব্য কেড়ে রেখে নাহি দেয় খেতে।।
তাহা শুনি আনন্দের অন্তরে বিষাদ।
বলে ভাই খামাকা কর না বিষম্বাদ।।
শোকে রোগে দায় ঠেকে ওঢ়াকান্দি যাই।
দায় মুক্তি চাই মোরা খেতে নাহি চাই।।
রোগী ভিন্ন অন্য অন্য যত লোক যায়।
পরম আদরে তারা পরমান্ন খায়।।
আনন্দ আনন্দ মনে করে বিবেচনা।
আ’জ যা’ব ওঢ়াকান্দি না খেয়ে আসব না।।
পথ শ্রান্ত উপনীত প্রভুর গোচরে।
সভক্তি প্রণাম করে শ্রীপদনখরে।।
রৌদ্র মধ্যে বসেছেন প্রভু দয়াময়।
প্রখর রৌদ্রের তাপ লাগিতেছে গায়।।
চতুঃপার্শ্বে ভক্তগণ বসেছে সকলে।
আনন্দ শ্রীধামে উপনীত হেনকালে।।
আনন্দ আনন্দে গিয়া বসিল তথায়।
প্রভু বলে আনন্দরে ঘরে গিয়া বয়।।
বাটী হ’তে পণ করে আসিলি এখানে।
না খেয়ে যাবি নে তবে রৌদ্রে র’লি কেনে।।
লক্ষ্মী মাকে ডেকে বলে এসেছে আনন্দ।
ভাল করে খাওয়াইবা করিয়া স্বছন্দ।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত চিনি নানা উপহার।
মিঠাই সন্দেশ আদি ব্যঞ্জনোপচার।।
আহারান্তে পদপ্রান্তে সভক্তি প্রণতি।
করিল আনন্দ মনে নিজালয় গতি।।
একাকী পথে হাটিতে ভাল বাসিতেন।
যেন কার সঙ্গে সুখে কথা কহিতেন।।
দৈববাণী চিন্তামণি বলে আনন্দেরে।
আমি যাহা বলি চল সেই ব্যবহারে।।
এ জগত মধ্যে তোরে করে দিব রাজা।
এ ভব সংসারে তোরে সবে দিবে পূজা।।
আনন্দ বলিল বড় কঠিন করণ।
আমি পারিব না তুমি শুন নারায়ণ।।
এক বর্ষ দুই বর্ষ ক্রমে গত হয়।
পুনর্বার শূন্য বাণী আনন্দেরে কয়।।
শোন্রে আনন্দ তুই বড়ই বলদ।
পথে পেয়ে চরণে ঠেলিলি উচ্চপদ।।
ফিরে তোরে বলি বেটা মম কথা শোন্।
তুচ্ছ নহে উচ্চপদ কররে গ্রহণ।।
বারংবার বলে তবু করে অস্বীকার।
প্রভুর হইল ক্রোধ আনন্দের পর।।
মম বাক্য অবহেলা কৈলি অকারণ।
এ বৎসর মধ্যে তোর নিশ্চয় মরণ।।
শূন্য বাণী শুনি হ’ল বিমর্ষ অন্তর।
সেই দিন হইতে শরীরে হ’ল জ্বর।।
মনে চিন্তা করি হরিচাঁদের চরণ।
তেতুল মরিচ গুলি খাইল তখন।।
স্নান করি কাঁচি দধি অন্ন দিয়া খেল।
জ্বরের পোষক আর ডাব নারিকেল।।
স্নান করি পান্থা ভাত খায় প্রতিদিন।
প্রাণে নাহি মরে কিন্তু হ’ল শক্তি হীন।।
অস্থি চর্ম সার হ’ল শরীর দুর্বল।
আশা মাত্র হরিচাঁদ দুর্বলের বল।।
প্রতিদিন গুলে খান তেতুলের গোলা।
জ্বরে জ্বর জ্বর তনু ক্রমে হ’ল পালা।।
একদিন জ্বর একদিন ভাল রয়।
যেইদিন জ্বর যেন মেরে থুয়ে যায়।।
চিন্তান্বিত ভয়ভীত শঙ্কাকুল মন।
ভাবে ত্রিশে চৈত্র মোর নিশ্চয় মরণ।।
মনে চিন্তা হরিচাঁদ দুঃখে ছাড়ে হাই।
ক্ষণে ভাবে এ বিপদে ওঢ়াকান্দি যাই।।
জনমের মত দেখে আসি রাঙ্গাপদ।
এ বিপদে শ্রীহরির শ্রীপদ সম্পদ।।
অধম তারণ হরি ত্রিজগৎ কর্তা।
হরিপদ হেরি করি শুভ ভব যাত্রা।।
কাঁদিতে কাঁদিতে হ’ল শ্রীধামে উদয়।
মনে দুঃখ অশ্রু জলে বক্ষ ভেসে যায়।।
প্রভু বলে ওরে বলদা আলি কি কারণ।
সাধা ধন অযতন নিশ্চয় মরণ।।
তাহা শুনি আনন্দ পড়িল রাঙ্গা পায়।
জনমের মত দাসে করুন বিদায়।।
মনে কত আশা ছিল না হ’ল পূরণ।
তব দাস হ’য়ে মম অকালে মরণ।।
মরণ হরণ তুমি শ্রীমধুসূদন।
শাস্ত্রে বলে তুমি যম ভয় নিবারণ।।
এইবার যদি মোরে রক্ষা না করিবে।
অধম তারণ নামে কলঙ্ক রহিবে।।
বহু স্তুতি নতি শুনি প্রীত দয়াময়।
মহাউদ্ধারণ হরি হইল সদয়।।
মহাপ্রভু বলে তুই এলি কি কারণ।
আনন্দ বলেন হরি করি নিবেদন।।
শুনিয়াছি বকজূড়ী গ্রামে সমাচার।
মহাধনবান আছে শ্রীকালু পোদ্দার।।
ব্রাহ্মণের ছেলে এক খুনী অপরাধে।
আদালতে ফাঁসী দিয়া তার প্রাণ বধে।।
ফাঁসী দিবে অগ্রে তারে করিল জিজ্ঞাসা।
কি খাইতে ইচ্ছা করে কিবা তোর আশা।।
দ্বিজ বলে নিজ প্রাণে নাহিক ভরসা।
দেখিব কালু পোদ্দারে এই মম আশা।।
তাহা শুনি জর্জ তারে দিল সমাচার।
তোমাকে দেখিতে চায় ব্রাহ্মণ কুমার।।
বার্তা শুনি পোদ্দার আসিল যশোহর।
উপনীত ত্বরান্বিত জর্জের গোচর।।
জর্জ বলে ব্রাহ্মণের কল্য হবে ফাঁস।
তোমাকে দেখিতে তার মনে অভিলাষ।।
বলেছে পোদ্দার কালু হয়ে অবনত।
এক নর জীবনের মূল্য হয় কত।।
জর্জ বলে এক লক্ষ মুদ্রা পরিমাণ।
এক নর জীবনের হয় ত সমান।।
পোদ্দার বলেছে এই এক লক্ষ মুদ্রা লহ।
মুদ্রা পরিবর্তে দ্বিজ পুত্রে ছেড়ে দেহ।।
জর্জের নিজের বাক্য লঙ্ঘিতে না পারে।
অতএব ছেড়ে দিল ব্রাহ্মণ কুমারে।।
এমারৎ নির্মাণ করিয়া দিল বিয়া।
জীবিকা যাহাতে চলে এমত করিয়া।।
মৃতপ্রাণ বাঁচাইয়া কীর্তি রাখিয়াছে।
সেই জন্য দয়াময় আইনু তব কাছে।।
তুমি বিনা হেন ধনী নাহি এই দেশে।
এ বিপদে প্রাণ দান করিবে এ দাসে।।
অবারিত অশ্রুধারা করে টলমল।
দেখি দীন দয়ালের দয়া উপজিল।।
ভয় নাই ভয় নাই প্রভু কহে বাণী।
যমে ত মানুষ মারে আমি তারে চিনি।।
যা বলদা বাটীতে আতঙ্ক নাহি আর।
তাহা শুনি আনন্দ চলিল নিজ ঘর।।
তথাপিও কতদিন দেহে র’ল জ্বর।
নাহি সারে নাহি বাড়ে র’ল একাকার।।
তিন মাস পরে শুয়ে দেখিল স্বপন।
স্বয়ং হরি দয়া করি দিল দরশন।।
আনন্দের মনে যেন হেন জ্ঞান হয়।
মাস তিন শ্রীহরি আছেন মমালয়।।
আনন্দ বলেন হরি করি নিবেদন।
বহু দিন মম বাড়ী করেছ গমন।।
এক বেলা যার বাড়ী করহ ভোজন।
তার বাড়ী চাউল লাগে দুই তিন মন।।
তিন মাস শ্রীনাথ রয়েছ মম ঘরে।
একজনে নাহি আসে তোমা দেখিবারে।।
এত শুনি মহাপ্রভু ক্রোধিত অন্তর।
আরক্ত লোচন দাঁড়াইল শূন্যোপর।।
মনে নাই সেই দিন বলিয়াছি তোরে।
কোন যমে নিবে তোরে দেখিব তাহারে।।
সেই হ’তে আমি ওঢ়াকান্দি ত্যাগ করি।
আশ্রয় করেছি তোর দুর্গাপুর বাড়ী।।
আনন্দের নিদ্রাভঙ্গ আনন্দ অপার।
নীরোগ শরীর নাহি প্লীহা নাহি জ্বর।।
আনন্দ বলে রে জ্বর! হয়েছিল পালা।
সর সর ওরে জ্বর সর সর পালা।।
তামাক সাজিয়া পরে জোরে দিল টান।
আনন্দের মাতা বলে হও সাবধান।।
জ্বরে জ্বর জ্বর তনু, বল নাহি গায়।
ধীরে টান দিও যেন মূর্ছা নাহি হয়।।
আনন্দ বলেন মাতা চিন্তা নাহি করি।
যে জন যমের যম তিনি মম বাড়ী।।
সে হইতে সেরে গেল প্লীহা আর জ্বর।
চির দয়া আছে সেই বংশের উপর।।
উঠিল মঙ্গল সোর আকাশ ভেদিয়া।
সবে হরি গুণ গায় নাচিয়া গাইয়া।।
ব্রাহ্মণ কায়স্থ আর কামার কুমার।
সাহা সাধু জোলা মুচি কি জাতি বিচার।।
পুরুষ প্রকৃতি সেজে কুলবতী কন্যে।
মজিল ডুবিল সবে হরি প্রেম বন্যে।।
পতি পিতা পুত্র ভ্রাতা ত্যজে সব নারী।
পাগলিনী সেজে যায় ওঢ়াকান্দি বাড়ী।।
অহরহ ওঢ়াকান্দি সে গোলার ঘাটে।
আকাশ প্রমাণ অদ্বৈত তুফান উঠে।।
কবি রসরাজ বলে শ্রীহরি চরণে।
আমার বলিতে কেহ নাই তোমা বিনে।।
তুমি মাতা পিতা ভ্রাতা নিয়ন্তা ভবের।
দাস ত্রাস নাশ তারকের কর্মফের।।