নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
পয়ার
সাধুসুত দশরথ উপাধি বৈরাগী।
রাউৎখামারবাসী মহা অনুরাগী।।
প্রভু যবে লীলা খেলা করে এই মতে।
এ সময় দশরথ প্রেমে যায় মেতে।।
প্রভুর সঙ্গেতে ফিরে সেই দশরথ।
হইলেন প্রভুর প্রিয় পরম ভকত।।
প্রভু স্থানে আসে লোক হ’য়ে ব্যাধিযুক্ত।
প্রভুর আজ্ঞায় তারা হয় ব্যাধিমুক্ত।।
তাহা দেখি মনে দুঃখী দশরথ ভক্ত।
রোগাভক্ত প্রভুকে করয় বড় ত্যক্ত।।
মনোদুঃখে দশরথ গিয়া প্রভুস্থানে।
করজোড়ে নিবেদিল প্রভুর চরণে।।
বহু লোক রোগযুক্ত হ’য়ে বহু দেশে।
রোগমুক্তি পাইতে তোমার ঠাই আসে।।
আত্মসুখী রোগাভক্ত ব্যাধিমুক্তে তুষ্ট।
তাহাতে আমার মনে হয় বড় কষ্ট।।
আমার মনের ইচ্ছা যত লোক রোগী।
সবাকার রোগ ল’য়ে আমি একা ভোগী।।
ওহে দয়াময় হরি আজ্ঞা কর তাই।
সবাকার রোগ ল’য়ে একা কষ্ট পাই।।
রোগী না থাকিলে ভবে কেহ আসিবে না।
তোমাকে ওরূপ করে ত্যাক্ত করিবে না।।
অহৈতুক ভক্তিমান ভক্ত আছে যারা।
প্রেমের পিপাসু হ’য়ে আসিবেক তারা।।
সেই সঙ্গে হ’বে সুখে প্রেম আলাপন।
দয়া করি বল নৈলে ত্যজিব জীবন।।
প্রভু বলে দশরথ একি কথা কও।
সংসারের রোগ কি উঠা’য়ে নিতে চাও।।
কর্মক্ষেত্র সংসারেতে কর্ম মহাবল।
সকলেই পায় কর্ম অনুযায়ী ফল।।
তবে তোর বাঞ্ছা হেতু দিব তোরে রোগ।
বার বৎসরের পরে হ’বে তোর ভোগ।।
পাইয়া প্রভুর আজ্ঞা হইল সন্তুষ্ট।
বার বছরের পরে হ’ল তার কুষ্ঠ।।
ঠাকুর বলেন বাছা আর কিবা চাও।
সংসার ছাড়িয়া এবে ভিক্ষা করি খাও।।
কত দিনে এইভাবে ভিক্ষায় প্রবৃত্ত।
আজ্ঞামতে করে নিল অযাচক বৃত্ত।।
একদা ঠাকুর তারে বলিল গোপনে।
ভিক্ষার্থে বেড়াও বাছা যেই যেই স্থানে।।
চাহিয়া কহিয়া ভিক্ষা কর না কখন।
হেঁটে যেতে সেধে দিলে করিও গ্রহণ।।
তাই ল’য়ে সন্ধ্যাকালে নৌকায় আসিও।
তাহাই রন্ধন করি এক বেলা খেও।।
বর্ষা আর শরৎ হেমন্ত গত হ’লে।
পদব্রজে ভিক্ষা মেগে খাইও সেকালে।।
বেড়াইও পদব্রজে ভিক্ষার নিমিত্ত।
যাচিয়া না লইও এ অযাচক বৃত্ত।।
বাকবন্ধ করিয়া থাকিবা ছয় মাস।
মারিলেও কিছু নাহি করিও প্রকাশ।।
রাত্রিতে থাকিও এক গৃহস্থ আলয়।
বাহিরে থাকিও এক কন্থা দিয়া গায়।।
একমাত্র ডোর আর একটি কপিন।
খুলিও না পরিয়া থাকিবা রাত্রিদিন।।
যে ডোর কপিন কন্থা করিবা ধারণ।
অন্য বস্ত্র কন্থা না পরিবা কদাচন।।
ছয় মাস গত হ’লে দিবসে বেড়াইও।
ভাবের ভাবুক হ’লে তার বাড়ী যেও।।
নিশিতে থাকিয়া তার সঙ্গে বল কথা।
তাহা ভিন্ন অন্য কথা না কহিও কোথা।।
দশরথ বলে যাহা চাই দিলে তাই।
প্রভু বলে আমি তোর বাসনা পুরাই।।
তোর যে ভাবনা আছে বহুদিন হ’তে।
ভাবিলে ভাবনা সিদ্ধি পারিলে ভাবিতে।।
যে যাহা ভাবনা করে ঠাকুরের স্থান।
অবশ্য অভীষ্ট পূর্ণ করে ভগবান।।
মোর ঠাই যেই ইচ্ছা করে সেই জন।
আমি তা জানিতে পারি সকল কারণ।।
যে যাহা প্রার্থনা করে এসে মম ঠাই।
সেই গীত আমি তার সাথে সাথে গাই।।
কর্মকর্তা ফলভোগে না হ’য়ে কি যায়।
সুকর্ম দুষ্কর্ম ফল অবশ্যই হয়।।
তা না হ’লে ঈশ্বরের ব্যবস্থা থাকেনা।
কিন্তু দৈবে সাধুসঙ্গ পায় যেই জনা।।
তার কাটে কর্মসূত্র সাধুর কৃপায়।
কর্মপাশ মুক্ত সেই দৈব ভাগ্যে হয়।।
নিঃস্বার্থ ভাবেতে যেই পর উপকারী।
অকামনা শুদ্ধ প্রেম তারে ব্যাখ্যা করি।।
আত্মসুখে কর্ম করে তাকে বলি কাম।
পরসুখে কর্ম করে ধরে প্রেম নাম।।
মম কষ্ট ভেবে মম সুখের নিমিত্তে।
তব ইচ্ছা সদা পর উপকার অর্থে।।
শ্লোক
আলোচ্য সর্ব্বশাস্ত্রাণি বিচার্য্য চ পুনঃ পুন।
ইদমেব সুনিস্পন্নং ধ্যেয়ো নারায়ণঃ সদা।।
পয়ার
ভাগবত তুমি তাহা জানিলাম সত্য।
তোমার প্রেমেতে আমি হইনু বিক্রিত।।
সর্বত্যাগী সর্বরোগী সর্বভোগী যেই।
মাধুর্যের পাত্র মহাভাগবত সেই।।
সর্ব ত্যাগ করে বাছা পরিলে কৌপিন।
সর্ব ত্যাগ সর্বভোগী হ’লে উদাসীন।।
কি ব্যাখ্যা করিব তোরে নাহি বলাবল।
কি ফল ব্যাখ্যিব তোরে নাহি ফলাফল।।
শুনিয়া পড়িল সাধু দণ্ডবৎ করি।
শ্রী হরি বলিয়া অম্নি করিল শ্রীহরি।।
দশরথ বলে আমি বড়ই জঘন্য।
তব বাক্য সত্য আমি আজ হ’তে ধন্য।।
অযাচক বৃত্তি ভিক্ষা প্রবৃত্ত হইল।
দেশে দেশে অইভাবে ভ্রমিতে লাগিল।।
ভ্রমণ করেন ঠাকুরের আজ্ঞা মত।
সে ভাবে জীবিকা রক্ষা করে অবিরত।।
ছেঁড়া কাঁথা গায় ডোর কৌপিন পরিয়া।
ছেঁড়া কানি মস্তকেতে চিবুকী বাঁধিয়া।।
বাক বন্ধ অন্তরে জপিত হরি বোল।
ভিক্ষা করিতেন করে করি কমণ্ডুল।।
মল্লকাঁদি ছিলেন বিশ্বাস মৃত্যুঞ্জয়।
মল্লকাঁদি ছেড়ে কালী নগরে উদয়।।
মাঝে মাঝে ঠাকুর আসেন মল্লকাঁদি।
অনুক্ষণ মৃত্যুঞ্জয় যান ওঢ়াকাঁদি।।
একদিন ঠাকুর বলেন মৃত্যুঞ্জয়।
করগে কালীনগরে বসতি আশ্রয়।।
তাহাতে ত্যজিয়া মল্লকাঁদির বাসর।
ভিটা ছাড়ি করে বাড়ী সে কালীনগর।।
দৈবযোগে একদিন সেই ভদ্রাসনে।
দশরথ উপনীত দিবা অবসানে।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ সূর্য নারায়ণ।
তার মধ্যে হইলাম আমি একজন।।
কহিতেছে দশরথ হরষিত মনে।
কল্য বাছা আমারে যে মেরেছে যবনে।।
মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসিল কেমনে মারিল।
হাসিতে হাসিতে সাধু কহিতে লাগিল।।
ঠাকুরের কথা আছে কথা না কহিব।
অযাচক বৃত্তি দ্বারা জীবন রাখিব।।
আউচ পাড়া যুধিষ্ঠির বিশ্বাস ভবনে।
উপস্থিত হইলাম দিবা অবসানে।।
বাক বদ্ধ প্রভু আজ্ঞা কথা নাহি বলি।
পাগল বলিয়া সবে হাতে দেয় তালি।।
রাখালে জিজ্ঞাসা করে আসিয়া নিকটে।
কথা নাহি বলি তারা সবে মারে ইটে।।
রাখালের যন্ত্রণায় হইনু অস্থির।
আমাকে দেখিতে পায় সেই যুধিষ্ঠির।।
রাখালে তাড়িয়া দিয়া মোরে ডেকে লয়।
তিনি কন এ কখন পাগল ত নয়।।
সেখানেতে ছিল রামকুমারের ভগ্নী।
নড়াইল নিবাসী ভবানী নামিনী।।
তিনি কন আমি চিনি পাগল নহেত।
মোদের ওঢ়াকাঁদির ঠাকুরের ভক্ত।।
যুধিষ্ঠির যত্ন করি করান ভোজন।
শল্যান্ন ও দধি দুগ্ধ সঘৃত ব্যঞ্জন।।
ভোজন হইল বেলা অপরাহ্ণ কালে।
প্রতিষ্ঠার ভয়ে আমি আসিলাম চলে।।
দিন ভরি ভিক্ষা করি যাই কলাবাড়ী।
সন্ধ্যাকালে গিয়াছিনু মিয়াদের বাড়ী।।
ঠাকুরের বাক্য আছে গৃহে যেতে মানা।
মিয়াদের বাড়ীতে কাছারী একখানা।।
সেই বাড়ী যখন হইনু অধিষ্ঠান।
মেয়েরা সকলে বলে এল ম্যাজমান।।
তাহারা বলিছে কাছারীতে ব’স এসে।
আমি বসে রহিলাম খেড়পালা পাশে।।
মেয়েরা সকলে এসে সুধায় আমায়।
বাড়ী কোথা বল তব যাইবা কোথায়।।
আমি নাহি কথা বলি হইয়া কাতর।
এক মিয়া বলে বেটা হ’বে বুঝি চোর।।
দশ বার জনে ঘিরে করে গণ্ডগোল।
কেহ চোর কেহ কহে বোবা কি পাগল।।
ধর চোর মার চোর করে হুড়াহুড়ি।
এক মিয়া এসে মোর টেনে ধ’রে দাড়ি।।
মিয়া কহে হারে চোরা কথা না কহিলি।
গরু চুরি করিবারে বসিয়া রহিলি।।
মিয়া মোর দাড়ি টেনে ধরিল যখনে।
আমি চাই উঠে যেতে দাড়ি ধ’রে টানে।।
মিয়া বলে গরুচোর পালাইতে চায়।
দাড়ি ছাড়ি ধরি চুল পৃষ্ঠেতে কিলায়।।
কিল খেয়ে পালাইতে চাই শীঘ্র গতি।
আর মিয়া এসে মোর পৃষ্ঠে মারে লাথি।।
আর মিয়া এসে মোর দাড়ি ছাড়াইল।
ঘাড় ঘুল্লা দিয়ে মোরে ঠেলিয়া আনিল।।
সেই মোর গ্রীবা ধ’রে যবে দেয় ঠেলা।
সে মিয়া কহিছে এর গলে দেখি মালা।।
সে মিয়া কহিছে এর মালা মোটা মোটা।
এ দেখি বৈরাগী এরে চোর বলে কেটা।।
হাতে দেখি ভিক্ষা হাঁড়ি তাহাতে চাউল।
ভিক্ষুক বৈরাগী হ’বে নেড়া কি বাউল।।
ইহাকে মারিতে মম হ’তেছে মমতা।
এত অপমান করি নাহি কয় কথা।।
কাহাকে মারিলি তোরা ধ’রে দাড়ি চুল।
কাহাকে মারিলি তোরা হারে নামাকুল।।
টানিয়া লইল মোরে বাড়ীর উপরে।
ফেলিয়া গায়ের কাঁথা দেখে দীপ ধরে।।
এত যে মারিনু তবু হা হা হুঁ হুঁ নাই।
এ কোন মহৎ হ’বে মনে ভাবি তাই।।
চোর যদি কুষ্ঠ ব্যাধি কেন ওর গায়।
এ ভাব ধ’রেছে কোন মহতের কথায়।।
রস পৈতৃকের ঘা দেখি যে গাত্র ভরা।।
এই দায় ঠেকে বুঝি এই ভাব ধরা।।
না জেনে আমারে মারে আরো করে রোষ।
মনে মনে বলি হরি না লইও দোষ।।
সংসারের দুঃখ দেখি লইয়াছি রোগ।
মেয়াদের দোষ হ’লে মোরে দেও ভোগ।।
হেসে হেসে দশরথ এই কথা কয়।
তাহা শুনি হাসিয়া কহেন মৃত্যুঞ্জয়।।
সাধে সেধে নিলে ব্যাধি হইলে অতুর।
ঠাকুর পরীক্ষা করে সহ্য কত দূর।।
এইভাবে দশরথ ভ্রমে ঠাই ঠাই।
রসনা বাসনা হরি হরি বল ভাই।।