নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
পয়ার
ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত জয়চাঁদ ঢালী।
তাহার বসতী ছিল গ্রাম ভূষাইলী।।
মধুমতী নদী তীরে ভূষাইলী গ্রাম।
পরগণে মকিমপুর জয়চাঁদ নাম।।
মকিমপুর কাছারী চাকরী ছিল তার।
কাছারীতে ভালবাসা ছিল সবাকার।।
নায়েব মহুরী কিংবা আমিন পেস্কার।
সবাই বাসেন ভাল, বাক্য মানে তার।।
জমিদার যদি কোন কার্য করিতেন।
জয়চাঁদ নিকটেতে সম্মতি নিতেন।।
রাণী রাসমণি তিনি বড় দয়াময়ী।
মর্ত লোকে জন্ম ভগবতী অংশ সেই।।
তাহার অধীন মকিমপুর পরগণা।
সদর কাছারী তার মকিমপুর থানা।।
আট টাকা মাহিয়ানা পা’ক যত জন।
দশ টাকা ছিল জয়চাঁদের বেতন।।
আমলারা মফঃস্বলে নজর পাইত।
জয়চাঁদ যদি সেই সঙ্গেতে যাইত।।
আমলারা নজর পাইত যেই খানে।
জয়চাঁদ নজর পাইত সেই সনে।।
এই মত সম্মানিত ছিল কাছারীতে।
অধর্মের কার্য না করিত কোন মতে।।
নড়াইল নিবাসিনী ভবানী নামিনী।
রাম কুমার বিশ্বাসের মধ্যমা ভগিনী।।
সেই মেয়ে আসিতেন ভূষাইল গ্রামে।
ছিলেন প্রমত্তা হরিচাঁদ নামে প্রেমে।।
তাহার নিকট শুনি হরিচাঁদ বার্তা।
জয়চাঁদ সমর্পিল মন প্রাণ আত্মা।।
জয়চাঁদে ভাই ভাই বলি ডাকিতেন।
জয়চাঁদ দিদি সম্বোধন করিতেন।।
ঠাকুরের মহিমা সে বহুত কহিল।
মন ভুলে জয়চাঁদ ভাবোন্মত্ত হ’ল।।
জয়চাঁদ কেঁদে কহে ভবানীর ঠাই।
ঠাকুর নিকটে আমি কেমনে বা যাই।।
কেমনে পাইব আমি ঠাকুরের দেখা।
ঠাকুরে না দেখে আর নাহি যায় থাকা।।
দেহ মন প্রাণ মম সকল নিয়াছে।
চর্ম চক্ষে দৃষ্টি মাত্র বাকী রহিয়াছে।।
দেহ মাত্র রহিয়াছে পিঞ্জরের প্রায়।
মন পাখী উড়ে গেছে ঠাকুর যথায়।।
আমি যে কি হইয়াছি বুঝা নাহি যায়।
হরিচাঁদ রূপ মম জেগেছে হৃদয়।।
ঝোরে আঁখি রূপ যেন দেখি দেখা যায়।
শীঘ্র নিয়া হরিচাঁদে দেখাও আমায়।।
তাহা শুনি সে ভবানী করিল স্বীকার।
তোমারে দেখা’ব নিয়া ঠাকুর আমার।।
দিন করিলেন যাব কল্য সকালেতে।
ভবানী থাকিল জয়চাঁদের বাটীতে।।
নিশি পোহাইল দোঁহে ভাব উন্মাদেতে।
চিন্তা জাগ্রদুন্মাদে ভাবনা বিচ্ছেদেতে।।
ব্রহ্ম মুহূর্তের কালে চলে দুইজনে।
প্রেমে গদ গদ বারি বহিছে নয়নে।।
প্রাতেঃ রাধানগরের বাজারে উদয়।
এক হাড়ি মণ্ডা ক্রয় করিল তথায়।।
পূর্বমুখী হ’য়ে চলে ঠাকুরের বাড়ী।
হাতে যষ্টি মস্তকেতে সন্দেশের হাড়ি।।
বাবা বাবা বলে হাই ছাড়ে বার বার।
মধুমতী নদী দোঁহে হইলেন পার।।
দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ সঘনে করিয়া।
চলিলেন তারাইল গ্রাম মধ্য দিয়া।।
খাগড়াবাড়ীয়া গ্রাম দক্ষিণ অংশেতে।
এক বেটা দস্যু ব’সে ধান্যের ভূমিতে।।
জমির টানিয়া নাড়া আলি বাঁধিতেছে।
দু’জনাকে দেখে সেই আলিতে ব’সেছে।।
সেই দস্যু জিজ্ঞাসিল কোথায় যাইস।
মেয়ে লোক সঙ্গে করি কি জন্যে আসিস্।।
একমাত্র মেয়েলোক করিয়া সঙ্গেতে।
কোথায় যাইস্ তোরা কোন সাহসেতে।।
জয়চাঁদ কহে আমি ওঢ়াকাঁদি যাই।
উনি মোর বড় দিদি, আমি ছোট ভাই।।
এক বাবা হরিচাঁদ বাবার উদ্দেশ্যে।
ভাই বুনে চলিয়াছি নির্বিকার দেশে।।
দস্যু বলে কি ঠাকুর পেয়েছিস তোরা।
মস্তকেতে হাঁড়ি তোর হাঁড়িতে কি ভরা।।
জয়চাঁদ বলে মোর হাঁড়িতে সন্দেশ।
দস্যু বলে কেন নিস করে এত ক্লেশ।।
কুপিণ্ডে যত বেটারা উঠা’য়েছে সুর।
যশা বৈরাগীর ছেলে হ’য়েছে ঠাকুর।।
জমিদারে নিল যার ভিটা বাড়ী বেঁচে।
সফলাডাঙ্গা ছাড়িয়ে ওঢ়াকাঁদি গেছে।।
সে ঠাকুর হ’ল কিসে জাতি নমঃশূদ্র।
সেও নমঃশূদ্র বেটা তুই নমঃশূদ্র।।
সে হ’ল ঠাকুর কিসে তার বাড়ী যাস্।
কিবা ঠাকুরালী তার দেখিবারে পা’স্।।
সন্দেশের হাঁড়িটারে নামা’য়ে রাখিয়ে।
না খাওয়ায়ে তোদের সে দিবে খেদাইয়ে।।
জয়চাঁদ বলে হাঁড়ি রাখিলেই হয়।
খেতে দিক নাহি দিক তার নাহি দায়।।
খেতে পাই না পাই, রাখিলে হয় হাঁড়ি।
তা বলে ত খেতে যাইব না তব বাড়ী।।
দস্যু বলে আয় তবে মম বাড়ী যাই।
অতিথির ভাত সে বাড়ীতে কভু নাই।।
ওরে বেটা ভণ্ড আর না করিস ছল।
সন্দেশের হাঁড়ি লয়ে মোর বাড়ী চল।।
মোর বাড়ী নামাইলে নাহি থুব ঘরে।
আমিও খাইব আরো খাওয়াব তোরে।।
জয়চাঁদ বলে আগে ওঢ়াকাঁদি যা’ব।
সেখানে খেতে না পেলে তোর বাড়ী র’ব।।
দস্যু বলে যা চলে তোর ঠাকুরের বাড়ী।
সেবা জন্যে মিষ্ট নিস্ হাতে কেন লড়ি।।
সন্দেশ লইতে হয় সেবার কারণ।
লড়ি নিস্ কার সঙ্গে করিবারে রণ।।
এত বলি দস্যু বেটা যষ্টি কেড়ে নিল।
আইলের নিম্নভাগে গাড়িয়া থুইল।।
পাড়াইয়া দিল লড়ি মাটির তলেতে।
জয়চাঁদ বলে লাঠি নিব মাটি হ’তে।।
দস্যু বলে ভাগ্য তোর রাখিলাম লড়ি।
সন্দেশের হাঁড়ি নিব কর যদি তেড়ি।।
বল্ গিয়া ওঢ়াকাঁদি তোর সে ঠাকুরে।
লাঠি নিল এক বেটা না দিল আমারে।।
তাহা শুনি জয়চাঁদ কাঁদিতে কাঁদিতে।
ওঢ়াকাঁদি উপনীত বিষাদিত চিতে।।
ঠাকুর বসিয়াছেন পশ্চিমাভিমুখে।
হেনকালে জয়চাঁদ দাঁড়া’ল সম্মুখে।।
ঠাকুর তখন বলিলেন জয়চাঁদে।
দস্যু হাতে পড়েছিলি বিষম প্রমাদে।।
যষ্টিখানা কেড়ে নিয়ে সে থুয়েছে গেড়ে।
ভাগ্যে সন্দেশের হাঁড়ি তোরে দিল ছেড়ে।।
তাহা শুনি জয়চাঁদ কাঁদিয়া ভাসায়।
হেন অন্তর্যামী নাথ কোথা পাওয়া যায়।।
প্রভুর নিকটে রাখি সন্দেশের হাঁড়ি।
পদে পড়ি জয়চাঁদ যায় গড়াগড়ি।।
হরিচাঁদ বলে ওরে বাছা জয়চাঁদ।
ঝগড়া করিলে তোর ঘটিত প্রমাদ।।
জয় বলে রাজ কার্যে যুদ্ধ করিয়াছি।
তার মত কতটারে পরাস্ত করেছি।।
পাঁচশত লোকের মহড়া একা দেই।
আমি জয় পরাজয় কা’রে দেই নেই।।
রণে যদি পাঁইতারা করি একবার।
পালাইয়া যায় লোক হাজার হাজার।।
অদ্য আমি বলহীন নহে কোন মতে।
তথাপি পরাস্ত মানি শৃগালের হাতে।।
সিংহের শাবক ইহা ধরিল শৃগালে।
সিংহ হ’য়ে ভয় হ’ল শৃগালের পালে।।
তব শক্তি ধৈর্য ডুরি বোঝা যে দিনেতে।
দিলেন ভবানী দিদি মোর মস্তকেতে।।
সেই হ’তে হারিয়াছি পূর্ব বুদ্ধি বল।
সে জন্য ছাড়িনু লাঠি নিল দুষ্ট খল।।
হেনকালে দয়ারাম ছেড়ে দিল গরু।
গরু রাখিবারে গেল বাঞ্ছাকল্পতরু।।
বলিলেন ভবানীরে বাড়ী মধ্যে যাও।
তুমি গিয়া খাও জয়চাঁদে খাওয়াও।।
আমি এই পালানেতে গরু চরাইব।
তোমরা খাইয়া এস বিদায় করিব।।
তাহা শুনি জয়চাঁদ বাড়ী মধ্যে গিয়ে।
ঠাকুর নিকটে পুনঃ আসিলেন খেয়ে।।
ঠাকুর বলেন তোরা আর কি করিবি।
এই ত দেখিলি মোরে আর কি দেখিবি।।
নয়ন মুদিয়া মোরে চিন্তিবি যখনে।
অমনি আমার দেখা পাইবি তখনে।।
যে লাঠি নিয়াছে কাজ নাহি সে লাঠিতে।
আমি এই লাঠি দেই রাখিস্ সঙ্গেতে।।
কারো সঙ্গে কখন না করিও জুলুম।
মালেকে যাইতে রণে দিলে সে হুকুম।।
অস্ত্র শস্ত্র না নিয়ে এ লাঠি নিয়ে যেও।
বিপক্ষেরে ঐ লাঠি ঘুরা’য়ে দেখাইও।।
যা হ’বার হইবেক ভয় করিও না।
এই লাঠি সর্ব জয়ী রণে হারিবে না।।
এই লাঠি অগ্রভাগ এইটুকু ফাঁড়া।
সুতা দিয়া বাঁধিয়া আগায় দিও জোড়া।।
প্রভুর শ্রীপদধূলি লইয়া মাথায়।
কাঁদিতে কাঁদিতে সাধু নিজ দেশে যায়।।
গৃহে আসি সেই লাঠি সুতায় বাঁধিল।
সযতনে তৈল জল মর্দন করিল।।
জয়চাঁদ মনে চিন্তা করে অনুক্ষণ।
নয়ন মুদিলে হরি দিবেন দর্শন।।
না দেখিলে সেইরূপ প্রত্যয় না হয়।
পরীক্ষা করিতে ধ্যানে বসিল সন্ধ্যায়।।
কত পাপ করিয়াছি নাহি লেখা জোখা।
দয়া করি প্রভু কি আমাকে দিবে দেখা।।
এত ভাবি জয়চাঁদ আরোপে বসিল।
নয়ন মুদিয়া রূপ চিন্তিতে লাগিল।।
করুণা নিধান হরি বুঝি ভক্ত মন।
জয়চাঁদে দয়া করি দিলেন দর্শন।।
কি সৌভাগ্য জয়চাঁদ হরি দেখা দিল।
রসরাজ অনুরোধ হরি হরি বল।।