নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
দীর্ঘ-ত্রিপদী
বসতি অযোধ্যাধাম, শ্রীরামভরত নাম,
বিপ্র কুলোদ্ভব মহাশয়।
বৈষ্ণবের শিরোমণি, মহাসাধু তপমণি,
সর্ব জীবে সম দয়া রয়।।
তীর্থ ভ্রমণ কারণে, গিয়াছিল বৃন্দাবনে,
হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ রব মুখে।
জয় রাধা রাণী জয়, বলিত সব সময়,
জয় হরি বলে ফিকে ফিকে।।
সাধুহাটি গ্রামে ঘর, শ্রী রসিক সরকার,
তিনিও ছিলেন বৃন্দাবনে।
শ্যাম কুণ্ডের নিকটে, শ্রীরাধা কুণ্ডের তটে,
দেখাদেখি হয় দুইজনে।।
দুই সাধু মেশামেশি, প্রেমরসে ভাসাভাসি,
হরি কথা প্রেমের আলাপে।
কহিছে রসিকচন্দ্র, মনেতে পরমানন্দ,
সাধু রামভরত সমীপে।।
কহ তব কোথা ধাম, কিবা জাতি কিবা নাম,
রসিকের শুনিয়া ভারতী।
বলে রামভরত নাম, উপাসনা রাম নাম,
অযোধ্যায় আমার বসতি।।
রামভরত জিজ্ঞাসে, তব ঘর কোন দেশে,
রসিক দিলেন পরিচয়।
বঙ্গদেশে মম ধাম, সাধুহাটি নামে গ্রাম,
রসিক আমার নাম হয়।।
জনম কায়স্থ কুলে, বের হই কৃষ্ণ বলে,
যদি প্রভু করিতেন দয়া।
করি তীর্থ পর্যটন, অযোধ্যাদি বৃন্দাবন,
ঘুচাইতে সংসারের মায়া।।
সাধু এ কথা শুনিয়া, দুই বাহু প্রসারিয়া,
জড়িয়া ধরিল রসিকেরে।
আমিও যেমন দুঃখী, তোমাকে তেমন দেখি,
বলিব কি যে দুঃখ অন্তরে।।
বাসনা হ’তে বৈরাগী, হয়েছি সংসার ত্যাগী,
রাম নাম করিয়া স্মরণ।
তবু মায়া ফাঁসী গুণে, সংসার বন্ধনে টানে,
ঘুচাইতে পারি না কখন।।
রসিক কহে তখন, কিছা করেছি ভ্রমণ,
কাশী কাঞ্চি অবন্তী মথুরা।
ভ্রমি অযোধ্যা ভুবন, আইলাম বৃন্দাবন,
ভ্রম মাত্র এ ভ্রমণ করা।।
ভ্রমণেতে কার্য নাই, এবে নিজ দেশে যাই,
মনের মানুষ যেই দেশে।
করিয়া তীর্থ ভ্রমণ, করি দিক দরশন,
রাজক্রিয়া মনের হাউসে।।
শুনামাত্র এই কথা, মনের মানুষ কোথা,
রামভরত কহে কাঁদি কাঁদি।
রসিক কহিছে তায়, মম মন যে ভোলায়,
সে মানুষ আছে ওঢ়াকাঁদি।।
মম প্রাণ তার ঠাই, তবু যে ঘুরে বেড়াই,
সে কেবল মনের বিকার।
শুন হে রামভরত, গুরু করি শত শত,
সে গুরু যে নাশে অন্ধকার।।
যেখানে সেখানে যাই, স্থান মাত্র দেখি ভাই,
দেখে শুনে জন্মিয়াছে হুঁশ।
শ্রীক্ষেত্র নৈমিষবন, নবদ্বীপ বৃন্দাবন,
নরলীলা সকলি মানুষ।।
এক মানুষের খেলা, সকল মানুষ লীলা,
আছে যারা তারাও মানুষ।
কত স্থানে কত মূর্তি, মানুষ গঠিত মূর্তি,
রক্ষাকারী তারাও মানুষ।।
আমি যে মানুষ বরে, জন্মিলাম ধরাপরে,
সেই মোর মনের মানুষ।
মনের কথা যে জানে, সে মানুষ সন্নিধানে,
যাই ভাই দেখি গে মানুষ।।
সাধু কহে রসিকেরে, সে মানুষ দেখিবারে,
আমি কি যাইতে পারি সাথে।
রসিক কহিছে তারে, সে মানুষ দেখিবারে,
বিশ্বাস কি হইবে মনেতে।।
ভরত কহিছে ভাই, আর ছাড়াছাড়ি নাই,
তুমি গুরু আমি যেন শিষ্য।
আমি ত যাইতে নারি, লহ মোরে সঙ্গে করি,
সে মানুষ দেখিব অবশ্য।।
আসিয়া রসিক সঙ্গে, উপনীত হ’ল বঙ্গে,
তারাইল কাছারীতে রয়।
তথা লইয়া চাকরী, সদা বলে হরি হরি,
সাধুহাটি মাঝে মাঝে যায়।।
থেকে রসিকের সঙ্গে, কৃষ্ণ কথা রসরঙ্গে,
এক এক বার উঠে কাঁদি।
কেঁদে কহে রসিকেরে, দেখা’বে বলিলে মোরে,
কবে ল’য়ে যা’বে ওঢ়াকাঁদি।।
রসিক কহিছে তারে, আমি যা ভাবি অন্তরে,
ভাবিলে ঠাকুর দেখা পাই।
আমি যাব পিছু ভাগে, তুমি যাও কিছু আগে,
ঠাকুর চিনিয়া লহ ভাই।।
ওঢ়াকাঁদি যাইবারে, রামভরত যাত্রা করে,
অন্তরেতে কাঙ্গালের ভাব।
বাহিরে দেখায় বেশ, নাহি যেন ভক্তি লেশ,
রাজসিক বীরত্ব স্বভাব।।
মহিষ চর্ম পাদুকা, মোজা তোলা পদ ঢাকা,
পরিধান রেশমের ধুতি।
গরদ চাদর গায়, নামাবলীটে মাথায়,
হাতে ধরা কাপড়ের ছাতি।।
বড় এক যষ্ঠী হাতে, চৌগোপ আছে মুখেতে,
মুখে হরি বোল বলি ধায়।
কতক পথ আসিয়ে, ক্ষণেক কাল বসিয়ে,
নয়নের জলে ভেসে যায়।।
রামভরত যাত্রা পথে, ওঢ়াকাঁদি শ্রীধামেতে,
সব ভক্তে কহে হরিচাঁদ।
তোরা সব থাক হুঁশ, আসিয়াছে এক মানুষ,
পূর্ণ হবে তার মনোসাধ।।
বলিতে বলিতে এসে, রামভরত প্রবেশে,
ওঢ়াকাঁদি প্রভুর বাটীতে।
উপস্থিত হ’য়ে একা, পাইয়া প্রভুর দেখা,
করজোড়ে দাঁ’ড়াল সাক্ষাতে।।
অনিমিষ বারি চক্ষে, প্রভুর শ্রীঅঙ্গ দেখে,
ছাতি লাঠি ছাড়িয়া দিলেন।
ঠাকুর বলেন বাঁচি, তোমা আমি চিনিয়াছি,
ভূমে লোটাইয়া পড়িলেন।।
ঠাকুর বলেন তায়, তোমার ঘর কোথায়,
কোথা হ’তে এলে মহাশয়।
কহিছে রামভরত, জান প্রভু ত্রিজগত,
দুঃখী দেখে চেন না আমায়।।
প্রভু হরিচাঁদ কয়, থাক থাক মহাশয়,
যত দিন লয় তব মন।
যাহা ইচ্ছা তাই খাও, যাহা ইচ্ছা তাই লও,
কর সদা শ্রীহরি সাধন।।
থেকে ওঢ়াকাঁদি ধাম, সদা করে হরিনাম,
দুই তিন দিন পরে যায়।
কভু যায় রোজে রোজে, ময়দা চাপড়ী ভাজে,
ভোগ দিয়া সন্ধ্যারতি গায়।।
ঠাকুরের আজ্ঞাধীন, রহিলেন কিছুদিন,
একদিন ঠাকুরকে কয়।
এবে আমি আসি গিয়া, কিছুদিন বেড়াইয়া,
আসিয়া মিলিব তব পায়।।
গিয়া তারাইল গ্রামে, থাকি কাছারী মোকামে,
পেয়াদা হইব বলি রয়।
করেন পেয়াদা গিরি, দিবানিশি বলে হরি,
গোমস্তা ভাবেন একি দায়।।
না করেন রাজ কাজ, থাকিয়া কাছারী মাঝ,
দিবানিশি হরিগুণ গায়।
ইনি হ’ন হরিভক্ত, ইহাকে করিতে ত্যক্ত,
আমার যে উচিৎ না হয়।।
আমরা করিলে ত্যক্ত, রাজজী হবে বিরক্ত,
আমাদের মহাপাপ তায়।
নায়েব কহে তখন, তুমি প্রেম মহাজন,
কাছারীতে থাকা যোগ্য নয়।।
তব কার্য সুমাধুর্য, মোরা করি রাজকার্য,
কি জন্য বিষয় মধ্যে রও।
জেনে যে মানুষতত্ত্ব, হইয়াছ উনমত্ত,
নয় সে মানুষ ঠাই যাও।।
আমরা বড় পাষণ্ড, কভু কারু করি দণ্ড,
তাহা দেখি তুমি দুঃখী হও।
কর গিয়া সাধু সঙ্গ, প্রেম কথা রসরঙ্গ,
যেখানে যাইয়া তুমি পাও।।
শুনিয়া এতেক বাণী, সাধু উঠিল অমনি,
ধীরে ধীরে করিল গমন।
যাত্রা করে হরি বলে, এমন সময় কালে,
আসিতেছে একটি ব্রাহ্মণ।।
পদেতে নাহি পাদুকা, তাহার পাইয়া দেখা,
পাদুকা ধরিয়া দিল তায়।
করে প্রেম কোলাকুলি, মস্তকের নামাবলী,
বেঁধে দিল তাহার মাথায়।।
গায় গরদ চাদর, বলে কার্য নাহি মোর,
এত বলি দিল তার গায়।
ফেলিয়া হাতের লাঠি, বাম হাতে এক ঘটি,
তাই ল’য়ে পূর্বদিকে ধায়।।
রূপদাস বৈরাগীরে, দেখা পাইয়া তাহারে,
হাতে হাতে ধরিয়া চলিল।
আসি তার আখড়ায়, ঘটি ধরি দিল তায়,
হাতের ছাতিটা তাকে দিল।।
বলে তার পায় পড়ি, আমার মস্তক মুড়ি,
দেও ভেক হইব বৈরাগী।
ষষ্টি রৌপ্য মুদ্রা ছিল, তাহারে ধরিয়া দিল,
বলে মোরে কর অর্থত্যাগী।।
তার অর্ধ মুদ্রা এনে, বিলাইল দুঃখী জনে,
দুই এক করি দরিদ্রকে।
অগ্রেতে মস্তক মুড়ি, ফেলিল চৌগোপ দাঁড়ি,
ডাকিয়া এনে পরামাণিকে।।
তসরের ধুতি ছেড়ে, ছেড়ে এক কাণি ফেড়ে,
ডোরক কপিন বানাইল।
পরিয়া ডোর কপিন, বলে আমি অতি দীন,
হরি বলে নাচিতে লাগিল।।
এমন কাঙ্গাল বেশে, পুনঃ ওঢ়াকাঁদি এসে,
লোটাইল ঠাকুরের পায়।
ঠাকুর বলিল শেষ, কোথা তোর সেই বেশ,
এই বেশে কে তোরে সাজায়।।
রমভরত বলে বাণী, যত সাজ কি সাজনী,
সাজিতে কাহার সাধ্য হয়।
যত সংসারের সাজ, সকল তোমার কাজ,
তোমা বিনা কে কারে সাজায়।।
নাচিয়াছ যেবা নাচ, সাজিয়াছ যেবা কাচ,
নাচ কাচ সব তুমি হও।
তুমি সূত্রধর হরি, একমাত্র সূত্র ধরি,
নাচ কাচ নাচাও কাচাও।।
ঠাকুর তাহারে কয়, এই ভাব যার হয়,
তার হয় এইসব সাজ।
হরিচাঁদ লীলাকথা, ভকত চরিত্র তথা,
কহে দীন কবি রসরাজ।।