নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
ত্রিপদী
গোস্বামী গোলোক, মাতাইল লোক,
হরিচাঁদ নাম দিয়া।
মত্ত হরিনামে, সদা কাল ভ্রমে,
ভকত ভবনে গিয়া।।
গিয়া সুর গ্রাম, করে হরিনাম,
আড়ঙ্গ বৈরাগী ঘরে।
পাগলে দেখিয়া, মেয়েরা আসিয়া,
আনন্দে রন্ধন করে।।
পাক হ’ল সারা, আসিয়া মেয়েরা,
গলে বস্ত্র দিয়া কয়।
হ’য়েছে রন্ধন, করুন ভোজন,
অন্ন জুড়াইয়া যায়।।
এমন সময়, শুনিবারে পায়,
যুধিষ্ঠির রঙ্গ বাসে।
সিঙ্গা সাতপাড়, ঠাকুর তোমার,
উদয় হ’লেন এসে।।
শুনিয়া পাগল, বলে হরি বোল,
উৎকণ্ঠিত হ’য়ে উঠে।
আড়ঙ্গেরে কয়, যাইব তথায়,
শীঘ্র লহ নৌকা ব’টে।।
নৌকা নাহি ঘাটে, পাগল নিকটে,
আড়ঙ্গ বৈরাগী কয়।
কহিছে পাগল, ছাড় গণ্ডগোল,
বিলম্ব নাহিক সয়।।
নাহি কিছু মানি, নৌকা দেহ আনি,
ঠাকুর দেখিতে যাই।
না দেখে ঠাকুরে, মরিরে মরিরে,
ত্বরায় তরণী চাই।।
যদি নাহি দেহ, তবে নিঃসন্দেহ,
আমি দিব জলে ঝাঁপ।
তাতে যদি মরি, আমি পা’ব হরি,
তোর হ’বে মহাপাপ।।
কি দিব তরণী, তরী একখানি,
জলেতে ডুবান আছে।
ভাঙ্গা বড় নাও, তাতে যদি যাও,
তবে দিতে পারি সেচে।।
দু’জনে হইলে, একেলা বাহিলে,
একজন ফেলে জল।
তবে যাওয়া যায়, সেই ভাঙ্গা নায়,
কর যদি এ কৌশল।।
মেয়েরা তখন, করিতে ভোজন,
পাগলকে কেঁদে কয়।
পাগল কহিছে, ক্ষুধা কার আছে,
তোর অন্ন কেবা খায়।।
মেয়েরা কাঁদিয়া, অন্ন দিল নিয়া,
খেল মাত্র দুই গ্রাস।
রায়চাঁদে কয়, শীঘ্র আয় নায়,
যদি দরশনে যা’স।।
পাগল কহিছে, নাও দেও সেচে,
যদি মোরে ভালোবাস।
বাহিয়া যাইতে, একজন সাথে,
দেহ নৈলে নিজে এস।।
নৌকা সেচে দিল, বৈঠা খানা নিল,
পাগল উঠিল নায়।
ঠাকুর দেখিতে, নৌকা বেয়ে যেতে,
রায়চাঁদ সাথে যায়।।
তরণী বাহিছে, বেগে চালা’য়েছে,
বিক্রমশালী বিশাল।
যাও যাও বলে, যাও যাও বলে,
পাগল সেচিছে জল।।
জোরে খোঁচ দেও, জোরে বাও নাও,
যদি দেহ জোর ছেড়ে।
জোর দিলে কম, আমি তোর যম,
মুণ্ড ফেলাইব ছিঁড়ে।।
মরি কিংবা বাঁচি, আছি কিনা আছি,
না জানিয়া মানি এত।
যা হও তা হও, নৌকা বেয়ে যাও,
এ নাও চালাও দ্রুত।।
যত বাহে নাও, তত বলে বাও,
বিলম্ব নাহিক সহে।
রায়চাঁদ বায়, যত শক্তি গায়,
কালঘর্ম দেহে বহে।।
নিঃশ্বাস প্রশ্বাস, ঘন ঘন শ্বাস,
মরণ প্রশ্বাস প্রায়।
ডা’ন হাতে জল, ফেলেছে পাগল,
বাম হাতে নাও বায়।।
ডালির উপরে, বক্ষঃ রাখি জোরে,
বামহাত জলে দিয়া।
জল টানি টানি, চলিল অমনি,
যায় তরণী বাহিয়া।।
অর্ধ পথে গিয়া, পড়িল শুইয়া,
বলে একা বেয়ে চল।
নৌকা চালাইবি, এ মতে বাহিবি,
নৌকায় না উঠে জল।।
রায়চাঁদ জোরে, বাহে বেগভরে,
নৌকায় না উঠে বারি।
উতরিল শিঙ্গা, পাগলের ডিঙ্গা,
অকূলে তরিল তরী।।
ঠাকুরকে দেখি, নৌকা ঘাটে রাখি,
দৌড় দিয়া চলে যায়।
প্রভু হরিচাঁদে, হেরি মনোসাধে,
অমনি পদে লোটায়।।
রহে দণ্ড চারি, ঠাকুরে নেহারী,
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে।
আমারে দেখিলে, এলে কিনা এলে,
যুধিষ্ঠির রঙ্গ ঘরে।।
কহিছে গোলোক, হইয়া পুলক,
ত্রিলোক পালক হরি।
যথা তথা রহ, নাহিক সন্দেহ,
উৎসাহে শ্রীপদ হেরি।।
আপনি সবার, জীবন আধার,
যান সবাকার ঠাই।
আসি পুলকেতে, আপনা দেখিতে,
এ বাড়ীতে আসি নাই।।
কহিল যখন, ঠাকুর তখন,
ক্রোধ রক্ত জবা চক্ষু।
এত বড় হলি, এ বাড়ী না এলি,
কি কহিলি ওরে মূর্খ।।
ছিলেন বসিয়া, ঠাকুর রুষিয়া,
দুরন্ত রাগের সাথ।
ঠাকুর তখনে, গোলোক বদনে,
মারিল চপটাঘাত।।
তখন গোলোক, অন্তরে পুলক,
বাহিরে পাবক ন্যায়।
এক লম্ফ দিয়া, ঠাকুরে লঙ্ঘিয়া,
ঘরের বাহিরে যায়।।
গোলোক দৌড়িয়া, ঘাটেতে আসিয়া,
অবিলম্বে নাও ছাড়ি।
রায় চাঁদে ফেলে, আসিয়া উঠিলে,
কুবের বিশ্বাস বাড়ী।।
এ দিকে ঠাকুর, ক্রোধিত প্রচুর,
রায় চাঁদে ডেকে কয়।
কোথায় ঠাকুর, পেলি এত দূর,
হারে দুষ্ট দুরাশয়।।
শুনিবারে পাই, আমি যথা যাই,
ও বলে আসে না তথা।
বুঝে দেখ মনে, আমারে কি মানে,
কেন কহে হেন কথা।।
কবে রে ঠাকুর, হ’লি এত দূর,
পোতায় ছিল না ঘর।
যার মেয়ে লোকে, মাঠে বই রাখে,
এত বৃদ্ধি কেন তার।।
প্রভু দেন গালি, যাহা যাহা বলি,
পাগলের বংশে নাই।
রঙ্গ বাড়ী থেকে, গালি দেন রুখে,
সেই বংশে আছে তাই।।
চক্র নাহি সোজা, চক্রী চক্র বোঝা,
কি চক্রে কারে ঘুরায়।
কুবের ভবনে, আসিয়া তখনে,
পাগল নিরস্ত হয়।।
কুবেরের বাসে, রায়চাঁদ এসে,
উপনীত যখনেতে।
কুবের নারীকে, বলেছেন ডেকে,
রায়চাঁদে দেও খেতে।।
রায়চাঁদ কয়, খাওয়ালে আমায়,
সঙ্গে করে এনেছিলে।
বহু পরিশ্রমে, আসি সিঙ্গা গ্রামে,
খুব ভাল খাওয়ালে।।
শুনিয়া পাগল, বলে হরি বোল,
জয় হরি বলে উঠে।
রুষিল দুরন্ত, যেমন জলন্ত,
পাবকে উল্কা ছুটে।।
কুবেরের ঘরে, আনিতে ঠাকুরে,
যুধিষ্ঠির বাড়ী যথা।
ঠাকুর আসিতে, ভক্তিযুক্ত চিতে,
কুবের গিয়াছে তথা।।
পায়স পিষ্টক, ব্যঞ্জনাদি টক,
লাবড়া ডাইল শাক।
ঠাকুরে আনিতে, ভক্তিযুক্ত চিতে,
এদিকে হ’য়েছে পাক।।
কুবেরের নায়, উঠে দয়াময়,
আসিতেছে তার বাসে।
পাগল শুনিয়া, ধাইয়া যাইয়া,
ঘাটে দাঁড়াইল রোষে।।
ঠাকুরে চাহিয়া, কহিছে ডাকিয়া,
আয় দেখি আয় আয়।
ঠাকুর কেমন, বুঝিব এখন,
কে কেমন দয়াময়।।
ঠাকুর আমায়, কে বলে কোথায়,
ঠাকুর বানালে কেটা।
তুই না ঠাকুর, বানালি ঠাকুর,
আমি ঠাকুরের বেটা।।
মানিনে ঠাকুর, অই যে ঠাকুর,
শতেক ঠাকুর এলে।
ঠাকুরে দেখিব, আজ কি ছাড়িব,
ঠাকুরে ডুবা’ব জলে।।
তুই যা’স যথা, আমি নাহি তথা,
এ কথা ভাবিস কেনে।
যাই কিনা যাই, দেখাইব তাই,
জানিতে পারিবি মনে।।
বক্ষঃ বিদারিয়া, দিব দেখাইয়া,
তেমন নির্বোধ নয়।
পর দেহ ধরি, কার দেহ চিরি,
অধিকার নাহি তায়।।
তার একজন, পবন নন্দন,
হৃদি বিদারী দেখায়।
করিল জহুরী, তাতে লাজে মরি,
পশু শিশু আমি নয়।।
যে জানে অন্তর, চিরিয়া অন্তর,
অন্তর দেখাতে হয়।
সে রহে অন্তরে, না রহে অন্তরে,
অন্তরের ধন নয়।।
থাকিয়া অন্তরে, কি জেনে অন্তরে,
মারিস অন্তর হ’য়ে।
কে তোর আপন, বুঝিব এখন,
আয় দেখি নাও বেয়ে।।
দিব জলাঞ্জলি, সব ঠাকুরালী,
যা থাকে আমার ভাগ্যে।
বুঝিব ক্ষমতা, আ’জ সেই ত্রেতা,
দেখুক ভকত বর্গে।।
এক এক বার, ভীষণ চীৎকার,
কহিছে সার রে সার।
অধরোষ্ঠ কম্পে, এক এক লম্ফে,
ভূমিকম্পে লম্ফে তার।।
ঠাকুর দেখিয়া, ভয়ে ভীত হৈয়া,
কহিছে কুবের ঠাই।
চেয়ে দেখ আড়ি, আজ তোর বাড়ী,
গিয়া মম কাজ নাই।।
অদ্য কিবা ঘটে, কি আছে ললাটে,
যাইব না ফিরে চল।
প্রভু পুনরায়, রঙ্গ বাড়ী যায়,
নাহি যেন বুদ্ধি বল।।
কুবের আসিল, পাগলে বলিল,
ঠাকুর এল না হেথা।
আমি অভাজন, করি কি এখন,
উপায় কি যা’ব কোথা।।
কহিছে গোলোক, কেন হেন শোক,
পিতা কি ছাড়িবে সুতে।
এল এল এল, না এল না এল,
দয়া কি পারে ছাড়িতে।।
দ্রব্য আদি যত, করেছে প্রস্তুত,
রাখিয়াছে ভারে ভারে।
মাথায় লইয়া, রঙ্গ বাড়ী নিয়া,
খাওয়ে এস বাবারে।।
ভরি দুই হাঁড়ি, রঙ্গদের বাড়ী,
কুবের যখনে যায়।
গললগ্নী বাসে, ভকতি উল্লাসে,
গোলোক পুলকে ধায়।।
রঙ্গের ঘাটেতে, যায় যখনেতে,
ঠাকুর আসিল ঘাটে।
গোলোক পাগলে, কুবের কহিলে,
হরিচাঁদের নিকটে।।
শুনিয়া শ্রীহরি, কহিল শ্রীহরি,
যুধিষ্ঠির রঙ্গে কয়।
কুবের সঙ্গেতে, আমি এখনেতে,
চলিলাম নিজালয়।।
সেইত তরণী, পাইয়া অমনি,
শ্রীহরি উঠিল নায়।
কুবের সঙ্গেতে, ব্যতিব্যস্ত চিতে,
আসিলেন নিজালয়।।
এল যুধিষ্ঠির, চক্ষে বহে নীর,
গোলোক আসিল তথা।
ভকত লইয়া, ঠাকুর বসিয়া,
কহিছেন মিষ্ট কথা।।
হস্তে ধরি ধরি, নিয়া অন্তঃপুরী,
কুবের তখনে দিল।
কে দিয়াছে এত, দ্রব্য অপ্রমিত,
মাতা লক্ষ্মী জিজ্ঞাসিল।।
যত কহে বাণী, লক্ষ্মী ঠাকুরাণী,
কুবেরকে লক্ষ্য করি।
কুবের কহিছে, জননীর কাছে,
চক্ষে ঝরে অশ্রুবারি।।
দেবী লক্ষ্মী মাতা, শুনিয়া সে কথা,
কহিছে রঙ্গের ঠাই।
তুমি কি করেছ, মনে কি ভেবেছ,
গোলোক তোমার ভাই।।
ঠাকুর যখনে, গোলোক বদনে,
করাঘাত করিলেন।
গোলোক কি দোষী, প্রভু কন রুষী,
গোলোকেরে মারিলেন।।
করিয়া শ্রবণ, ঠাকুর তখন,
যুধিষ্ঠির প্রতি কয়।
মোর এই ছল, এই কথা বল,
কি হইবে ব্যবস্থায়।।
গোলোক তাহাতে, কুবের বাড়ীতে,
রহে ঈশ্বর ভাবিয়া।
গোলোক সাহায্য, কি করেছে কার্য,
আবার নিকট গিয়া।।
কুবের বাড়ীতে, গোলোক যাইতে,
আমাকে করেছে মানা।
তোমার বাটীতে, আমাকে রাখিতে,
গোলোকের সে বাসনা।।
অপূর্ব অপূর্ব, কুবেরের দ্রব্য,
তোমার বাটীতে যায়।
আমি খা’ব তাই, শুনিবারে পাই,
গোলোক পাঠায়ে দেয়।।
গোলোক তোমার, করে উপকার,
তার কি করেছ তুমি।
ঠাকুর নিয়াছ, মনে কি ভেবেছ,
ঠাকুর হ’য়েছি আমি।।
মেরেছি গোলোকে, তব বাড়ী থেকে,
তুমি কেন কাঁদিলে না।
গোলোক কারণে, আমার সদনে,
মাথা কেন কুটিলে না।।
ঈশ্বরের কাজ, জগতের মাঝ,
জীবের শুধু পরীক্ষা।
লোকেরে দেখায়ে, কন্যাকে মারিয়ে,
বউমাকে দেন শিক্ষা।।
সামাল সামাল, আপনা সামাল,
কপালে কি কার আছে।
পর দুঃখে দুঃখী, পর সুখে সুখী,
এ ভাবে প্রেম রয়েছে।।
হ’য়েছে ঠাকুর, গৌরব প্রচুর,
ভেবেছ কি বুঝি বুঝি।
কাজে পাওয়া যায়, সব পরিচয়,
কে কেমন কাজে কাজী।।
বৈষ্ণবের পদে, ক্ষুদ্র অপরাধে,
মহা মহা মহাজন।
বলে হরি হরি, সাধে কল্প ভরি,
হরি না পাবে সে জন।।
যেই হরি ভজে, ভকত সমাজে,
যে পূজে ভকত পায়।
বুঝিয়া ভজন, করে যেই জন,
হরিপদ সেই পায়।।
সব পরিহরি, বল হরি হরি,
থাকহ ভকত মাঝ।
কহে মনোসাধে, হরিচাঁদ পদে,
রায় কবি রসরাজ।।