নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
পয়ার
সোজা সুজি চলিলেন উত্তার নয়নে।
পথ কি বিপথ তাহা কিছুই না জানে।।
বাড়ীর উত্তর পার্শ্বে থেকে কিছুক্ষণ।
ঝুঁকে ঝুঁকে করে হরিনাম উচ্চারণ।।
পরিধান বস্ত্র ফেলে কিঞ্চিৎ ছিঁড়িয়া।
চলিলেন মাত্র এক লেংটি পরিয়া।।
সম্মুখে বাঁধিল অগ্রে বিল খাগাইল।
মল্লবিল হাটঝাড়া, তালতলা বিল।।
বেথুড়িয়া ঘৃতকাঁদি বিল খাল যত।
কতক হাঁটিয়া পার সাঁতরেতে কত।।
জপিতে গাইতে হরে কৃষ্ণ রাম নাম।
উপনীত ওঢ়াকাঁদি প্রভুর শ্রীধাম।।
বীররসে রাগাত্মিকা ভাবের উদয়।
দেখি প্রভু হীরামনে ক্রোড়েতে বসায়।।
হীরামনে পুকুরের ঘাটে ল’য়ে পরে।
শ্রীকরেতে শ্রীনাথ শ্রীঅঙ্গ ধৌত করে।।
কর্দম শৈবাল অঙ্গে লেগে রহিয়াছে।
কমল কণ্টক অঙ্গ ক্ষত করিয়াছে।।
ধৌত করি হস্ত ধরি গৃহেতে লইল।
কর্পূর মিশ্রিত তৈল অঙ্গে মাখাইল।।
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে ওরে হীরামন।
কেমনে করিলি সহ্য যবন পীড়ন।।
এত কষ্ট দিল দুষ্ট পাপিষ্ঠ যবন।
এত মান্য নেড়েরে করিলি কি কারণ।।
ঘৃণা কি হ’ল না কিছু ওরে বাছাধন।
কচ্ছপের কাঁচা মাংস করিতে ভোজন।।
হীরামন বলে মন সকলই ত জান।
জেনে শুনে তবে আর জিজ্ঞাসিলে কেন।।
সকলে কেবল কহে ফকির ফকির।
হক আল্লা ব’লে নেড়ে ছাড়িল জিগির।।
আমি ভাবি হক আল্লা বলিল মুখেতে।
হক ছাড়া না হক সে করিবে কি মতে।।
পোড়াইয়া দিল অঙ্গ তাহা করি সহ্য।
তবু ভাবি এই বুঝি করে হক কার্য।।
পোড়া অস্ত্র ধরে গ্রীবা মেরুদণ্ড পর।
তবু আমি ভাবি এত আল্লার নফর।।
আল্লার ফকির বলে আগে মানিলাম।
ঠগ মানিলাম শুনে হক আল্লা নাম।।
আল্লা রূপা রাধা আল্লা কৃষ্ণ আহ্লাদিনী।
প্রণয় বিকৃতি রাধা কৃষ্ণ প্রণয়নী।।
‘কামবীজ কৃষ্ণ’ ‘কাম গায়ত্রী রাধিকা’।
কৃষ্ণমন্ত্রবীজ রাধা প্রধানা নায়িকা।।
কৃষ্ণ বীজ কলিম, রহিম বীজ শক্তি।
‘ক’ কারে ‘ল’ কার ‘ই’ কার চন্দ্রবিন্দু যুক্তি।।
‘ক’ ‘ল’ ‘ই’ বিন্দু আর বিসর্গ অনুস্বার।
‘ম’ কারে অনুস্বার ইহা কৈলে একতর।।
তাতে হয় কৃষ্ণবীজ বীজরূপা রাধা।
কলিম শক্তির বীজ শ্রীকৃষ্ণ আরাধা।।
শ্লোক
রাধাকৃষ্ণ প্রণয়বিকৃতিহলাদিনী শক্তিহ্রস্ব-
দেকাত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদৌ
গতৌ তৌ, চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা,
রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্।
পয়ার
সেই’ত হ্লাদিনী শক্তি সবাকার হক।
সেই হক তুমি হরি সবার জনক।।
যার মনে যেই মত সেই পথে ধায়।
যে ভাবে যে ভাবে ডাকে ডাকে হে তোমায়।।
তাহাতেই মানিলাম তুমি আল্লা হক।
তোমাকে ডাকিল ভাবি তোমার সেবক।।
তাই ভাবি মানিয়া অমান্য কিসে করি।
যাহা কহে তাহা করি থাকি ধৈর্য ধরি।।
এ বুঝি হকের কার্য হয় ফকিরের।
তাই ভেবে কাঁচা মাংস খাই কচ্ছপের।।
প্রভু কহে তবে কেন মারিলিরে বাপ।
মানিয়া না মানিলে ত হ’তে পারে পাপ।।
হীরামন বলে পাপ-পুণ্য নাহি জানি।
আমি জানি তুমি হর্তা কর্তা রঘুমণি।।
সে বলে যে পাগলারে খাওয়ারে হারাম।
তার বাক্য শুনে মনে জাগে সীতারাম।।
হারাম শুনিয়া রসনায় বাড়ে ক্ষুধা।
দিল মাংস খাইলাম সুধাধিক সুধা।।
পিটমোড়া দিয়া টেনে বাঁধে দুই কর।
বাঁধিয়া মারিল গোঁজা নখের ভিতর।।
এই মত শাস্তি দিল যবনের বেটা।
নখতলে বিঁধাইল খেজুরের কাঁটা।।
তথাপি ভাবিনু যেই বলে আল্লা হক।
সে মেরেছে এতে নয় খ’সে যাবে নখ।।
বেকী দা পোড়ায়ে যবে আনে পুনর্বার।
এ দেহে তখনে সহ্য না হইল আর।।
এ সময় তোমাকে দেখিনু গদাধর।
গদা ধরি দাঁড়াইলা মস্তক উপর।।
ক্রোধে কাঁপে ওষ্ঠাধর আজ্ঞা দিলে মোরে।
মার ফকিরেরে মার চৈতন্য বালারে।।
তব শ্রীমুখের আজ্ঞা যদি পায় হীরে।
ব্রহ্মাণ্ড ডুবা’তে পারে গোষ্পদের নীরে।।
ত্রেতাযুগে তব শ্রীমুখের আজ্ঞা পাই।
আঠার বর্ষের পথ এক লম্ফে যাই।।
আনিনু গন্ধমাদন তব কৃপাগুণে।
কপি তনু ধরি হনু ভানুকে শ্রবণে।।
ব্রাহ্মণ অগস্ত্য মুনি তব কৃপালেশে।
সপ্ত সমুদ্রের জল খাইল গণ্ডূষে।।
চন্দ্র সূর্য শূন্যে চলে অচল সচল।
বাসুকিরে দিলে শিরে ধরা ধরা বল।।
মম শিরে দাঁড়াইয়া আজ্ঞা দিলে তাই।
যবনে মানিস কেন ওতে কিছু নাই।।
তব পাদপদ্ম দৃষ্টি করি দয়াময়।
ঝাঁকি দিলে কণ্টক বন্ধন খ’সে যায়।।
কোপ দৃষ্টে কটা ভেক পানেতে চাহিয়া।
কোপ দিলে ভেক বেটা পড়িল শুইয়া।।
ঈষৎ আঘাত মাত্র লাগিল মাথায়।
লাগিল সামান্য কোপ ফকিরের পায়।।
মারিতে দিলে না প্রভু তুমি কৈলে মানা।
মারিতে আমার মনে হ’ল বড় ঘৃণা।।
সকল তোমার খেলা কি খেলা খেলাও।
করিয়া করাও রঙ্গ মারিয়া মারাও।।
মহাপ্রভু বলে আর কহিতে হবে না।
জানি সব তবু ইচ্ছা তোর মুখে শুনা।।
বাছা তোর অঙ্গ ধৌত করেছি যখন।
বাহু নখ ব্যাথা মম ঘুচেছে তখন।।
পোড়া অস্ত্রে অঙ্গ পুড়ে করে কৃষ্ণবর্ণ।
চেয়ে দেখ মম অঙ্গে সেই সব চিহ্ন।।
তাহা দেখি হীরামন কেঁদে ছাড়ে হাই।
এই জন্য আমি কোন কষ্ট পাই নাই।।
হীরামন বলে আজ্ঞা কর শ্রীনিবাস।
যবনেরে সবংশেতে করিব বিনাশ।।
প্রভু বলে তোর কিছু হবে না করিতে।
স্বকর্মে হইবে ধ্বংস আপন পাপেতে।।
মম প্রাণাধিক তুই উত্তম পুরুষ।
পরাধীন নহ বাছা খাসের মানুষ।।
যথা তথা আছ বাছা তথা আমি আছি।
তোর কাছে বাছা আমি বিক্রিত হ’য়েছি।।
ত্রেতাযুগে বিভীষণে বলে ভগবান।
সাধুর জীবন মৃত্যু উভয় সমান।।
অমনি বাহির হ’ল বিবর্ত পাগল।
অনুক্ষণ মহাভাবে থাকেন বিহ্বল।।
অদ্ভুত করুণ হাস্য রসেতে বিভোলা।
কভু থাকে গৃহেতে কখন বৃক্ষতলা।।
কভু থাকে শ্মশানে কখন থাকে জলে।
কভু থাকে বনে কভু ধান্য ভূমি আ’লে।।
কখন বসিয়ে থাকে কখন শুইয়ে।
অবিরাম করে নাম ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে।।
যেচে দিলে কিছু খায় নৈলে অনাহার।
অন্ন ব্রহ্ম জ্ঞান নাহি জাতির বিচার।।
প্রখর রৌদ্র বর্ষণে নাহি ছায়া ছত্র।
শীতে গ্রীষ্মে সমভাব নাহি পাখা বস্ত্র।।
কখন উলঙ্গ কভু পরে মাত্র লেংটি।
বিল খাল নদ নদী পার হয় হাঁটী।।
ভাদ্রমাসে মধুমতি বানস্রোত বয়।
হিল্লোল কল্লোল করে দেখে লাগে ভয়।।
সেই জলে হীরামন হেটে পার হয়।
তরঙ্গ উঠিলে মাত্র জানু ডুবে যায়।।
কভু বিল মধ্যে দিয়া হেটে পার হয়।
কভু বক্ষ ডুবে কভু সাতারিয়া যায়।।
জলে ভাসে হীরামন হংসের আকার।
কেহ বলে গোঁসাই উঠহে নৌকাপর।।
ধরিতে পারে না কেহ বলেন গোঁসাই।
কার নৌকা বাহিব নিজের খানা বাই।।
এইভাবে গোস্বামীর বিহার বিরাজ।
কহিছে তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।