নতুনের খোঁজে-নতুন দিগন্তে
ত্রিপদী।
গোস্বামীর অনুমতি, বন্দি মাতা সরস্বতী,
মুঢ়মতি আমি অভাজন।
শক্তিময়ী দিয়া শক্তি, আমা দ্বারা কর উক্তি,
পঞ্চাশ বর্ণ স্বর ব্যঞ্জন।।
নাহি মোর বর্ণজ্ঞান, নাহি সূক্ষ্মানুসন্ধান,
সাহসিনু লিখিতে পুস্তক।
যদ্যপি জ্ঞানবিহীন, তবু মম শুভদিন,
লিখিতে এ হাতের সার্থক।।
হৃদিপদ্ম প্রস্ফুটিত, মন বড় আনন্দিত,
রচিতে হরি চরিত্র লীলা।
এই মঙ্গলাচরণ, ভববন্ধন মোচন,
শুনিতে মঙ্গল সুশৃঙ্খলা।।
কৃষ্ণসারচর্ম দলে, কুঠার বাঁধিয়া গলে,
অই দলে জুড়ি দুই হাত।
দন্তে তৃণ ধরি কেঁদে, সাধু বৈষ্ণবের পদে,
কোটি কোটি করি দণ্ডবৎ।।
হরিকথা লীলামৃত, কে বলিতে পারে কত,
যে যত বা করেন প্রকাশ।
মুনিগণে লেখে যত, ধ্যান অনুযায়ী মত,
বেদব্যাস কবি কৃষ্ণদাস।।
লেখে যদি শূলপাণি, বাণী যদি বলে বাণী,
তবু বাণী অবধি না হয়।
আমি যে সাহস করি, লিখিতে কলম ধরি,
সাধু গুরু বৈষ্ণব কৃপায়।।
কার্য অতি দুরারোধ্য, লিখিতে নাহিক সাধ্য,
হেন সাধ্য যেনতেন মতে।
লিখি লীলা গুহ্য বাহ্য, গ্রন্থকার মনোধার্য,
পূজ্য হোক ভক্ত সমাজেতে।।
বেদব্যাস মহামুনি, যত লিখিলেন তিনি,
চারিবেদ আঠার পুরাণ।
শাস্ত্র লেখে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম, গ্রন্থ লেখে লক্ষ লক্ষ,
দেখিল যাহা করিয়া ধ্যান।।
একদা বদরিকাশ্রমে, ব্যাস মুনি ছিল ঘুমে,
হেনকালে আসি দুই পাখী।
বদরী শাখা উপরে, দুই পাখী শব্দ করে,
ব্যসদেব মেলিলেন আঁখি।।
শাখে বসি দুই শুকে, একটি কহিছে সুখে,
অবিরত ত্রয়োস্ত্রিংশৎ।
অন্যটির মুখে বাণী, শুনিতেছে ব্যাসমুনি,
উঠে ধ্বনি পঞ্চপঞ্চাশৎ।।
বাণী শুনি অকস্মাৎ, ব্যাস করে দৃষ্টিপাত,
পাখী কেন সংস্কৃত কহে।
তাহা শুনিয়া বিস্ময়, সত্যবতীর তনয়,
কিঞ্চিৎ ধ্যানস্থ হ’য়ে রহে।।
ধ্যানেতে হইল জ্ঞাত, উভয় পাখীর তত্ত্ব,
ত্রয়োস্ত্রিংশৎ যে করে প্রকাশ।
অইটি বাল্মীকি মুনি, দেখেছেন ব্যাস মুনি,
পঞ্চপঞ্চাশৎ কহে ব্যাস।।
পাখী কহে সংস্কৃত, ইহার কারণ অর্থ,
জানিবারে পুনঃ করে ধ্যান।
বাল্মীকি কহিছে বাণী, রচি রামায়ণ খানি,
করিয়াছি নামের বাখান।।
ধর্ম অর্থ পাপ পুণ্য, ব্যবস্থা হয়েছে ধন্য,
প্রথম পুরুষ রামলীলে।
বৈকুণ্ঠ নায়ক হরি, যৈছে অবতারকারী,
বর্ণিলাম স্বয়ং হরি বলে।।
স্বয়ং কৃষ্ণলীলা সার, শুদ্ধ মানুষাবতার,
তাঁর তত্ত্ব তাঁর প্রাপ্তি কিসে।
তাহা আমি লিখি নাই, ধ্যানেতে ও নাহি পাই,
তুমি তাহা লেখ অবশেষে।।
ব্যাস কহে শুকপাখী, আমি যে ভারত লিখি,
বৈকুণ্ঠ পতির সব লীলা।
বাসুদেব যদুবংশ, নারায়ণ কৃষ্ণ অংশ,
লিখি তার ঐশ্বর্যের খেলা।।
লিখিবারে তার মর্ম, ব্যাখ্যা করিয়াছি ব্রহ্ম,
স্বয়ং কৃষ্ণ মাধুর্যের সার।
কোন প্রেমে তারে পাই, আমি তাহা লিখি নাই,
তুমি তাহা করহে প্রচার।।
গ্রন্থ হ’বে ভাগবত, সাধুজন মনোমত,
ব্রজভাব মাধুর্যের ধার্য।
গ্রন্থ হ’বে পরচার, ভক্তিরস তত্ত্বসার,
রসিক ভকত শিরোধার্য।।
শুনি ব্যাস ভাবে মনে, ব্যাস কহে ব্যাস স্থানে,
এরা দুই শুক শ্যাম শুক।
এরা কহে রচিবারে, এ রচনা রচিবারে,
এবে আমি না হ’ব ইচ্ছুক।।
ফিরে যাক যোগে বসা, দেখি করিয়া তপস্যা,
তপস্যায় বসিলেন মুনি।
কতদিন গত হয়, দৈবে এমন সময়,
শুনিতে পাইল দৈববাণী।।
শীঘ্রই রচনা কর, বৃথা কেন কাল হর,
উপলক্ষ তোমারে রাখিব।
লিখিতে উদ্যোগী হও, করে তুলি তুলি’ লও,
যা করিবে আমি সে করিব।।
এই দৈববাণী শুনি, লিখিতে লাগিল মুনি,
কৃষ্ণলীলা রস ভাগবত।
লিখিতে লিখিতে গ্রন্থ, ব্রজলীলার বৃত্তান্ত,
ব্রজলীলা লিখে মনোরথ।।
শান্ত দাস্য সখ্য আদি, বাৎসল্যের নিরবধি,
মধুরের রাধা প্রেমরস।
দাস্য শান্ত ক্রিয়াগুণ, লিখিতে হ’ল নিপুণ,
মধুরের ক্রিয়া গুণ যশ।।
লিখিতে উদ্যত হ’ল, হেন কালেতে শুনিল,
দৈববাণী হ’ল পুনর্বার।
আর না লিখ আগত, ব্রজভাব তত্ত্ব যত,
তা লিখিবে নন্দন তোমার।।
পরে ব্যাস পুত্র যিনি, শুকদেব মহামুনি,
তিনি লিখিলেন ভাগবত।
লিখিতে লিখিতে মুনি, পরে হ’ল দৈববাণী
আর না লিখিও তুল হাত।।
কতদিন গত হ’ল, ব্যাস ভাবিতে লাগিল,
আমি লিখি আমি করি সই।
যদ্যপি লেখান হরি, জানিতে তা আমি পারি,
অন্যে তাহা জানিল বা কই।।
দৈববাণী শুনিলাম, আমি একা জানিলাম,
গ্রন্থ মান্য হ’বে স্বর্গমর্ত্য।
গোলোক বৈকুণ্ঠ মান্য, হইল যে গ্রন্থ ধন্য,
দেবগণে না জানিল তত্ত্ব।।
গোলোক বিহারী হরি, গণপতি রূপ ধরি,
হ’য়েছেন শিবের নন্দন।
কোলে করিয়া ভবানী, হ’ল গণেশ জননী,
কোলে আদি ব্রহ্ম সনাতন।।
এবে বক্তা আমি হ’ব, গণেশেরে লেখাইব,
চলিলেন কৈলাশ শিখর।
স্তব করে মহামুনি, ব্যাসের স্তবন শুনি,
তুষ্ট হ’ল দেব দিগম্বর।।
আজ্ঞা দিলে গণেশেরে, যেতে ব্যাস সমিভ্যারে,
গণেশ বলিল আমি যা’ব।
বলিতে বিলম্ব হ’লে, হস্ত অবসর পেলে,
লিখিব না ফিরিয়া আসিব।।
শুনি ব্যাস চমকিত, হইলেন উপস্থিত,
বৈকুণ্ঠ নারায়ণ সদনে।
গললগ্নী কৃতবাসে, স্তব করে পীতবাসে,
তুষ্ট হরি ব্যাসের স্তবনে।।
ব্যাস কহিছে ভারতী, ভারতে যাবে ভারতী,
ভাগবত-ভারত রচনে।
আমি যা বলিব বাণী, বাণী যোগাইবে বাণী,
বসি মম রসনা আসনে।।
আজ্ঞা দেন চক্রপাণি, আজ্ঞায় চলিল বাণী,
গজানন কহে পুনর্বার।
কণ্ঠে রহিবে ভারতী, বলিবেন যে ভারতী,
লিখিব হে যে সাধ্য আমার।।
খালি হ’লে মসিপাত্র, মসি ফুরাইলে মাত্র,
আর না লিখিব যা’ব ফিরি।
শুনি ব্যাস বারিনেত্র, আমি হ’ব মসিপত্র,
ডেকে কন শ্বেত বাগীশ্বরী।।
শুনিয়া এ সব বার্তা, ব্যাস মুনি করে যাত্রা,
গোলোকের পানে চাহি কাঁদে।
গোলোকে ছিলেন স্থিতি, যিনি নীল সরস্বতী,
তাকে করে আজ্ঞা কালাচাঁদে।।
বৈকুণ্ঠেতে শ্বেতবাণী, মসিপত্র হ’বে তিনি,
তুমি গিয়া হও তাতে মসী।
কজ্জ্বলস্বরূপা হ’য়ে, তুমি তাতে থাক গিয়ে,
আমি তব পিছে পিছে আসি।।
আসি ব্যাস মুনিবর, গণেশের বরাবর,
কহে দেব লিখ কহি কথা।
ডেকে বলে শিব-পুত্র, দিলে মোরে মসিপত্র,
লিখিবার লেখনিটা কোথা।।
এরণ্ডের কুঞ্চি আনি, দিলা ব্যাস মহামুনি,
অস্ত্র দিল প্রস্তুতে কলম।
কূপিলেন গজানন, ক্রোধে ঘূর্ণ ত্রিনয়ন,
বলে ব্যাস তোর মতিভ্রম।।
বাণীকণ্ঠে বিরাজিত, শ্বেত সরস্বতী দত,
কালী হ’ল নীল সরস্বতী।
এতে মোর আসে হাস, তার কি কলম বাঁশ,
কি পত্রে বা লিখাইবি পাঁতি।।
গিয়া বৃন্দাবন বাসে, ভ্রমণ চৌরাশী ক্রোশে,
বেল ভাণ্ডি তমালের বন।
বন ভ্রমি একে একে, গন্ধরাজ শেফালিকে,
তালতরু দেখে হৈল মন।।
বসি তালতরু মূলে, ভেসেছে নয়ন জলে,
হরি বলে কাঁদে উচ্চৈঃস্বরে।
আমি শক্তি কৃষ্ণাঙ্গিণী, ভাগবত শাস্ত্র মুনি,
লেখ তুমি মম বক্ষঃ পরে।।
দেখে পরাশর পুত্র, পড়িতেছে তালপত্র,
তালপত্রে কহে মুনিবর।
যাহ শ্রীকৃষ্ণের ঠাই, বলগে বলেছে রাই,
শিরে শিখিপাখা দিতে মোরে।।
ব্যাস অতি ব্যস্ত হ’য়ে, শ্যামকুণ্ড তীরে গিয়ে,
করেছেন কৃষ্ণ আরাধন।
যুগল মিলন হ’য়ে, ব্যাসের সম্মুখে গিয়ে,
রাধা কৃষ্ণ দিল দরশন।।
বলেছেন শ্রীরাধিকে, যা লিখিবে মম বুকে,
অন্য কলমে তা কি হয়।
শুনিয়া রাধার বাণী, রাধানাথ রসখনি,
শিখিপাখা দিলেন তাহায়।।
শিখিপুচ্ছ অংশ করি, ব্যাসেরে দিলেন হরি,
হাসিয়া বলেন রাধানাথ।
যাহ অনন্ত গোচরে, জিহ্বা সে দিবে তোমারে,
তাহাতে না কর অস্ত্রাঘাত।।
উদয় ক্ষীরোদ কূলে, তপ করে হরি ব’লে,
হরি ছিল অনন্ত শয়নে।
ফণা এক কোন হ’তে, এক জিহ্বা হৈল তাতে,
এনে দিল ব্যাসমুনি স্থানে।।
বলীকে ছলিতে হরি, নাভি হ’তে পদতরী,
বাহির করিল যে প্রকার।
তেমনি অনন্ত ফণা, জিহ্বা কণা এক কণা,
প্রকাশিল ক্ষীরোদ ঈশ্বর।।
কলম কালি সহিত, সুচিক্কণ মনোগীত,
মিশ্রিত করিলা শিখিপুচ্ছে।
বাসুদেব নন্দসুত, ঘন সৌদামিনীবৎ,
অঙ্গে অঙ্গ মিশ্রিতায় যৈছে।।
তেমনি মিশ্রিত হ’ল, কলম আনিয়া দিল,
গণেশের কলম করেতে।
মসী নীল সরস্বতী, মস্যাধারে শ্বেত সতী,
গণপতি লাগিল লিখিতে।।
ব্যাসের মুখ নিঃসৃত, গণেশের নিজ হস্ত,
লিখিল ভারত ভাগবত।
আমি অতি অভাজন, সাধন ভজনহীন,
বিদ্যাহীন না জানি সংস্কৃত।।
ত্রেতাযুগে সেতু বন্ধে, ভল্লুক বানরবৃন্দে,
বড় বৃক্ষ আনে বড় বীরে।
বড় বড় যে পর্বত, বানরেরা আনে কত,
হনুমান লোমে বন্ধি করে।।
রামকার্য করিবারে, ব্যস্ত ভল্লুক বানরে,
কাষ্ঠ বিড়ালের হৈল মন।
পড়িয়া সমুদ্র নীরে, গড়াগড়ি দিয়া তীরে,
সেতুবন্ধ উপরে গমন।।
মনে মনে বিবেচনা, শ্রীপদে পাবে বেদনা,
বালি দিলে খাদ পূর্ণ হয়।
পন্থা হয় সুকোমল, যতেক কাষ্ঠ বিড়াল,
কার্য করে সাধ্য অনুযায়।।
সেইমত লিখি পুঁথি, হরিচাঁদ লীলাগীতি,
রামকার্য মার্জারের ন্যায়।
আমি অজ্ঞ নাহি যোগ্য, মার্জার হ’তে অযোগ্য,
হরিলীলা মহাযজ্ঞ প্রায়।।
সজ্জনের দয়াগুণ, হরিচাঁদ লীলা গুণ,
প্রকাশিয়া সে গুণ গাওয়ায়।
যদ্যপি লেখনী ধরি, বলি এ বিনয় করি,
শ্রোতাগণ মহাজন পায়।।
শ্রোতাগণ হংসবৎ, দোষ ছাড়ি গুণ যত,
দুগ্ধবৎ করুণ গ্রহণ।
হরিলীলামৃত কথা, তেমনি করি মমতা,
কর্ণপথে পিও সর্বজন।।
হরিলীলা শ্রবণেতে, ভবসিন্ধু পারে যেতে,
পাতকীর নাহি আর ভয়।
ঘুচিবে শমন শঙ্কা, হরিনামে মার ডঙ্কা,
ধর পাড়ি ভাস ঐ নায়।।
দশরথ হীরামন, মহানন্দ শ্রীলোচন,
রামকান্ত যশোমন্ত পদে।
গুরুচাঁদ কৃপালেশ, গোলোক নৃসিংহ বেশ,
তারক রচকাভয় সাধে।।